তুলে নেওয়া হলো ইতালির লকডাউন

পর্যটকশূন্য ভেনিসের ‘হাহাকার’

ইতালির জলকন্যা ভেনিস। ১২ উৎসবের এই নগরে একের পর এক উৎসব লেগেই থাকে। সারাবছর পর্যটকের ভিড়ে গমগমে পরিবেশ। বিশেষ করে বছরের এই সময়টাতে ভেনিসে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এত মানুষ, এত আবেগ, ভালোবাসা ধারণ করার ক্ষমতাও ভেনিস মাঝেমধ্যে হারিয়ে ফেলে। যে কারণে গেল কয়েক বছর ধরে ভেনিসকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় সরকার নানা রকমের পরিকল্পনা করছে। কীভাবে ভেনিসের ঐতিহ্য আরও যুগ-যুগান্ত বাঁচিয়ে রাখা যায়, মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে রাখা যায়, সেই পরিকল্পনায় তারা মগ্ন। এর মধ্যে বেশকিছু পরিকল্পনার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। যেমন: ভেনিস ঘিরে সাবমার্সিবল বাঁধ নির্মাণ করা। যা জোয়ারের পানি বা জলোচ্ছ্বাস থেকে ভেনিসকে রক্ষা করবে।
পর্যটকশূন্য ভেনিস। ছবি: স্টার

ইতালির জলকন্যা ভেনিস। ১২ উৎসবের এই নগরে একের পর এক উৎসব লেগেই থাকে। সারাবছর পর্যটকের ভিড়ে গমগমে পরিবেশ। বিশেষ করে বছরের এই সময়টাতে ভেনিসে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এত মানুষ, এত আবেগ, ভালোবাসা ধারণ করার ক্ষমতাও ভেনিস মাঝেমধ্যে হারিয়ে ফেলে। যে কারণে গেল কয়েক বছর ধরে ভেনিসকে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় সরকার নানা রকমের পরিকল্পনা করছে। কীভাবে ভেনিসের ঐতিহ্য আরও যুগ-যুগান্ত বাঁচিয়ে রাখা যায়, মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে রাখা যায়, সেই পরিকল্পনায় তারা মগ্ন। এর মধ্যে বেশকিছু পরিকল্পনার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। যেমন: ভেনিস ঘিরে সাবমার্সিবল বাঁধ নির্মাণ করা। যা জোয়ারের পানি বা জলোচ্ছ্বাস থেকে ভেনিসকে রক্ষা করবে।

বছরের এই সময়গুলোতে ভেনিসের প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মানুষের অতিরিক্ত ভিড়ে যেনো কোনো অঘটন না ঘটে, সেই জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু, এ বছর তেমন কিছুই নেই। কোনো কিছু করার দরকার হয়নি। যতদূর চোখ যায় শুধু নিস্তব্ধতা আর নীরবতা।

দীর্ঘ প্রায় চার মাস লকডাউন থাকার পরে ৪ জুন থেকে ইতালির লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। ভেনেতোর প্রাদেশিক সরকার ভেনিসের জন্য লকডাউন তুলে নিয়েছে আরও একদিন আগে। অর্থাৎ ৩ জুন। এখন ঘোরাঘুরি করতে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে কোনো বাধা নেই। শুধুমাত্র কোনো আবদ্ধ জায়গায়, গণপরিবহনে বা ভিড়ে গেলে মাস্ক ব্যাবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

লকডাউন না থাকার স্বাধীনতা উপভোগ করতে ভেনিসের মূল ভূখণ্ডে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখা হয় সময় টিভির সাংবাদিক মাকসুদ রহমানের সঙ্গে। তিনি অনেক বছর ধরে ভেনিসের মূল ভূখণ্ডেই থাকেন। সাংবাদিকতার বাইরে ব্যবসাও করেন। প্রতিনিয়ত ভেনিস দেখেন, ভেনিসের মানুষ দেখেন।

মাকসুদ রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর এক বৈচিত্র্যময় নগর সভ্যতা হলো ভেনিস। এর নিজস্ব ঐতিহ্য ও বাণিজ্য ধরে রাখতে এখানের অধিবাসীরা সব সময় সচেষ্ট থাকেন। এখানের মানুষের আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি। তারা নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থাভাজন ভাবতে পছন্দ করেন।’

তিনি বলেন, ‘ভেনিসের রূপ বর্ণনা করা অনেক শক্ত কাজ। এর বৈচিত্র্য এত বেশি যে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কেউ যদি ডানদিকে তাকায় একই সময়ে তিনি বামদিকের কোনো একটা মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য মিস করবেন।’

‘ভেনিসের মানুষরা ভেনিসকে এত বেশি ভালোবাসেন যে তারা মনের করেন, তাদের ভালোবাসার কারণে বিগত ৫০০ বছরেও ভেনিসে বড় কোনো দুর্যোগ হয়নি। বাইরে থেকে কেউ এসে ভেনিসের ক্ষতি করে যেতে পারেনি। সামান্য পকেটমারও এই শহরে টিকতে পারে না’, যোগ করেন তিনি।

পর্যটকশূন্য ভেনিস। ছবি: স্টার

ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুরাগী মাকসুদ রহমান বলেন, ‘১৭৯৭ সালে নেপোলিয়ন ভেনিস দখল করে নিয়েছিলেন। অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারও ভেনিস দখল করেছিল। কিন্তু, কেউ ভেনিসিয়ানদের (ভেনিসের স্থানীয়দের ইতালিয় ভাষায় ভেনিসিয়ান বলে) দমাতে পারেনি। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার থেকে একতিল সরাতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক বৈরিতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকা ভেনিসিয়ানরা শুধু টিকেই থাকেননি, হাজার বছরের চেষ্টায় প্রাকৃতিক বৈরিতাগুলোকে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিণত করেছেন। বিনোদনের আইটেম বানিয়েছেন। পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছেন। কিন্তু, এবার পারেননি। ভেনিসের নীরবতা দেখলে বুকের ভেতরে হাহাকার করে উঠে। মনে হয়, নীরবে চোখের পানি ঝরাচ্ছে জলকন্যা।’

‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভেনিসে বেশি হয়নি, কিন্তু অন্য দশটা শহরের মতো ভেনিসও থমকে গেছে। ভেনিসে কোনো পর্যটক নেই। গেল ফেব্রুয়ারি মাসের ঐতিহাসিক কার্নিভ্যাল উৎসব থামিয়ে দেওয়া হলো করোনাভাইরাসের কারণে। এর পরে ভেনিস আর জাগেনি। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান-পাট সব বন্ধ। প্রায় দুই লাখ মানুষ বেকার হয়ে ঘরে বসে আছেন। এই ক্ষতি যে কবে পোষাতে পারবে ভেনিস, তা বলা একদম সহজ নয়। তবে, অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেতে পারে, এক থেকে দেড় বছরের আগে ভেনিস ‘রিপারতিরে’ (রিস্টার্ট) করবে না’, বলেন মাকসুদ রহমান।

তিনি মনে করেন, ‘আগামী এক বছরের মধ্যে ভেনিসের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ব্যবসার হাত বদল হবে। এত বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। বিশেষ করে অভিবাসী ব্যবসায়ীরা পড়বেন বেশি বিপদে। দোকান ভাড়া, লাইসেন্স ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ জোগান দিতে গিয়ে অনেকে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না।’

তবে, এত কিছুর ভেতরেও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নিয়ে আশার আলো দেখেন মাকসুদ রহমান। তার মতে, ভেনিসের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা যদি কষ্ট করে হলেও এই ঝড়ে টিকে থাকতে পারেন, তবে আগামীতে এর সুফল বাংলাদেশিরাই ভোগ করবেন। ভেনিসের ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় একটা অংশ বাংলাদেশিদের দখলে চলে আসা অসম্ভব কিছু নয়। শুধু বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে কাজ করতে হবে এবং লেগে থাকতে হবে।

আমি মনে করি, ভেনিসের প্রাণ ‘পর্যটক’ নেই সত্যি, কিন্তু ভেনিস আছে। রূপসী ভেনিসের রূপ-যৌবন আরও বেশি জ্বলজ্বল করছে। এত স্বচ্ছ পানি, পরিষ্কার আকাশ আমি আগে কখনো দেখিনি। ছোট ছোট খালগুলোতেও ঝাঁক বেঁধে মাছের দল খেলা করছে। ডলফিন ঝাঁপাঝাঁপি করছে। যা নিকট অতীতে কল্পনাও করা যায়নি।

আমরা এক নতুন ভেনিস পেয়েছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে টইটম্বুর ভেনিস। কোথাও কোনো দূষণ নেই। প্রতি নিশ্বাসে মানুষের ফুসফুসে ঢুকছে শতভাগ বিশুদ্ধ বাতাস। এই সতেজতায়, বিশুদ্ধতায় ভর করে ভেনিস আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আবার পর্যটকমুখর হবে। খুলবে ব্যবসা-বাণিজ্য। ঘরে বসে থাকা মানুষগুলো আগের মতো কাজে-কর্মে যোগ দেবে। অপেক্ষা শুধু এইটুকুর।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago