ভিআইপি হাসপাতালের যদি কিন্তু…

প্রতীকী ছবি

করোনায় আক্রান্ত ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতাল বা হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে—এরকম একটি সংবাদ গণমাধ্যমে এলে তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছিল। পরে সরকারের তরফে জানানো হয়, এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতাল হচ্ছে না। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্তত তিনটি হাসপাতালকে করোনায় আক্রান্ত ভিআইপিদের জন্য ডেডিকেটেড রাখা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার:

১. উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউই ভিআইপি না হলেও বাংলাদেশের মতো পুঁজিবাদী এবং অবৈধ আয়ের অবারিত সুযোগ থাকার দেশে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যবসায়ীদের টাকায় চলে, সেখানে ধনীরাও ভিআইপি। অতএব তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য শুধু তিনটি নয়, দশটি হাসপাতাল ডেডিকেকেটেড বা সংরক্ষিত রাখতে চাইবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। মনে রাখা দরকার, যাদের পয়সা আছে, স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে তারা কেউই দেশে চিকিৎসা করাতেন না। সবাই থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর যেতেন। কিন্তু করোনার মহামারির কারণে যেহেতু তারা বাধ্য হয়ে দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং এই সংখ্যাটি যেহেতু অনেক; উপরন্তু বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স-এর সাম্প্রতিক গবেষণাও বলছে যে, বাংলাদেশে ধনী লোকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, ফলে এই ধনকুবের ও তাদের পরিবারের লোকজন করোনায় আক্রান্ত হলে কোথায় যাবেন? যেহেতু এ মুহূর্তে বিদেশে যেতে পারছেন না বা ব্যক্তিগত বিমানে অথবা বিমান ভাড়া করে সবাই যেতে পারছেন না, অতএব তাদের দেশেই তাদের জন্য কয়েকটা হাসপাতাল নির্ধারিত বা সংরক্ষিত রাখা যেতেই পারে—এই ধারণার সাথেও হয়তো অনেকে একমত পোষণ করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসাটা পাচ্ছে কি না? সংবিধান বলছে, জনগণই রাষ্ট্রের ক্ষমতার মালিক। সুতরাং এই সাধারণ মানুষের করোনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা যদি সঠিকভাবে না হয় এবং যদি নির্দিষ্ট কিছু লোক ও গোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্র আলাদা ব্যবস্থা রাখে, তাহলে সেটি সংবিধানের লঙ্ঘন। সংবিধান স্পষ্ট বলে দিয়েছে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। আর সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

২. অনানুষ্ঠানিকভাবে যে হাসপাতালগুলো ভিআইপিদের জন্য নির্ধারিত বা সংরক্ষিত বলে শোনা যাচ্ছে, তার মধ্যে একটিকে সম্পূর্ণ ডেডিকেটেড রাখা হয়েছে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশে কূটনীতিক এবং তাদের পরিবারের জন্য। অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় করোনা চিকিৎসার সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এই হাসপাতালে এখনও কোনো কূটনীতিক বা তাদের পরিবারের কেউ ভর্তি হয়েছেন বলে জানা যায়নি। ফলে বিশাল অবকাঠামো আর সর্বোচ্চ সুবিধা থাকার পরও হাসপাতালটি রোগীশূন্য—যখন অন্যান্য হাসপাতালে বেড খালি নেই। এমনকি প্রিয়জনের জন্য একটি আইসিইউ পেতে অসংখ্য মানুষ হাহাকার করছেন। বাংলাদেশে যেসব কূটনীতিক অবস্থান করেন, তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব এবং তাদের জন্য একটি হাসপাতালকে সংরক্ষিত রাখার পক্ষেও হয়তো মতামত পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে জানতে হবে, দেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য কী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে?

৩. করোনায় পেশাজীবীদের মধ্যে পুলিশ ও চিকিৎসকরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। একক পেশা হিসেবে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। ৪ জুন পর্যন্ত মারা গেছেন পুলিশের ১৭ জন সদস্য। মাঝখানে শোনা গিয়েছিল পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য একটি প্রাইভেট হাসপাতাল ডেডিকেটেড রাখা হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, পুলিশ সদস্যরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করেন। মানুষের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করেন। অতএব তাদের সুস্থতা এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য একটি হাসপাতাল সংরক্ষিত রাখে এবং সেখানে তাদের চিকিৎসা হয়, সেটিকে সাধুবাদ দেওয়াই যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরাও যে গণহারে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের চিকিৎসা কোথায় হবে? তাদের জন্য কি কোনো হাসপাতাল ডেডিকেটেড করা হয়েছে? চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিসের (এফডিএসআর) হিসাব অনুযায়ী, ৪ জুন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১ হাজার ১৬ জন চিকিৎসককে শনাক্ত করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮ জন চিকিৎসক। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও পাঁচ জন।

৪. ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে সাংবাদিকদের কথা ভুলে গেলেও চলবে না। ৪ জুন পর্যন্ত ৮০টি গণমাধ্যমের মোট ২৪৫ জন কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন তিনজন। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও তিনজন। সাংবাদিকদের সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন বিজেসি নিজেদের সদস্য ও পরিবারের সদস্যদের করোনা পরীক্ষার জন্য আলাদা ব্যবস্থা নিয়েছে। শোনা গিয়েছিল একটি প্রাইভেট হাসপাতালের সঙ্গেও তাদের চুক্তি হয়েছে যে, কোনো সাংবাদিককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন হলে তাকে ওই হাসপাতালে নেওয়া হবে। এটিও নিশ্চয়ই এক অর্থে ভালো খবর যে, ফ্রন্টলাইন ফাইটার সাংবাদিকদের জন্যও একটি হাসপাতাল অন্তত ডেডিকেটেড করা গেলো। এভাবে ভিআইপি, পুলিশ, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ আরও অনেক পেশাজীবীর লোকেরা হয়তো চাইবেন তাদের সবার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতাল হোক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষের চিকিৎসাটা  ঠিকমতো হচ্ছে কি না?

সাধারণ মানুষ কারা?

সাধারণ মানুষ তারাই যাদের দেবার মতো বিশেষ পরিচয় নেই। যারা ধনী নন; যারা পুলিশ-চিকিৎসক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ-প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা বা বিশেষ করপোরেট ব্যক্তি নন। আপনার বাসার নিচে যে লোকটি মাছ মাংস সবজি বিক্রি করেন, তিনি সাধারণ মানুষ। আপনি যে গণপরিবহনে চড়ে অফিসে যাতায়াত করেন, সেই বাসের চালক-হেলপার ও রিকশাচালকরাই সাধারণ মানুষ। আপনি যার কাছে চুল কাটান, যিনি আপনার জুতা পালিশ করে দেন, জামা কাপড় ইস্ত্রি করে দেন, যে কৃষক আপনার খাবার যোগায়, যে শ্রমিক আপনার বাড়ি তৈরি করে দেয়, যে লোকটি আপনার গৃহকর্মীর কাজ করে, যে লোকটি আপনার বাড়ি পাহারা দেয়, যে মানুষগুলো প্রতিদিন রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করে আপনার পরিবেশ দুর্গন্ধমুক্ত রাখে—তারাই সাধারণ মানুষ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান কিছু শিক্ষক বাদ দিলে বাকি লাখ লাখ শিক্ষকও সাধারণ মানুষ। কল-কারখানার শ্রমিক, বেসরকারি চাকরিজীবী, দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এমনকি বড় কিছু পদ বাদ দিলে সরকারি কর্মচারীরাও সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ লোকই সাধারণ মানুষ।

এই বিপুল জনগোষ্ঠীর করোনা এবং নন করোনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সঠিকভাবে যদি না হয়—তাহলে নির্দিষ্ট কিছু লোক ও গোষ্ঠীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখাটা চরম বৈষম্যমূলক এবং সেটি পরিষ্কারভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন।

হাসপাতালে গিয়ে সেবা না পেয়ে ফিরে আসার খবর গণমাধ্যমে নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে। আবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা করোনার উপসর্গ নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় বা অ্যাম্বুলেন্সে প্রাণ গেছে—এরকম ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হয় যে মুক্তিযোদ্ধাদের, সেরকম একজনকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে। নিজের জীবন বাজি রেখে যে মানুষটি দেশকে স্বাধীন করলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আগের বছরে এসে সেই মানুষটিকে বিনা চিকিৎসা মরে যেতে হবে, এটি পুরো রাষ্ট্রের লজ্জা। কিন্তু আমরা জানি না, একজন মুক্তিযোদ্ধার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না। এই যদি হয় অবস্থা, যদি বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত রেখে শুধু ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়, সেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

তাহলে সমাধান কী?

সমাধান খুব সহজ এবং সরকার আপাতদৃষ্টিতে সে পথেই হাঁটছে তা হলো, দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা হতে হবে। গত ২৪ মে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে যে, সব হাসপাতালে কোভিড এবং নন কোভিড রোগীদের জন্য আলাদা ইউনিট করতে হবে এবং কোনো রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত পাঠানো যাবে না। যদি এটা কার্যকর করা যায়, অর্থাৎ কৃষক-মজুর-কামার-শিক্ষক-গৃহিণী-গৃহকর্মী সবাই যদি তার বাড়ির কাছের হাসপাতালে গিয়ে করোনা এবং অন্য রোগেরও চিকিৎসা পান, তাহলে ভিআইপিদের জন্য কতটি হাসপাতাল সংরক্ষিত রাখা হলো, সেটি নিয়ে কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে চিকিৎসার বাইরে রেখে বা চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে রাষ্ট্র যদি শুধু পয়সাওয়ালা আর ভিআইপিদের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে এটি একসময় জনরোষ তৈরি করতে পারে।

পরিশেষে…

ঢাকার বাইরে গুরুতর অসুস্থ কোনো চিকিৎসক, পুলিশ বা অন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে যেভাবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়, একজন মুমূর্ষু কৃষককেও সেভাবে হেলিকপ্টারে নিয়ে আসা হবে, এরকম বৈষম্যহীন ও মানবিক একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি; কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যে কত কঠিন, তাও আমাদের অজানা নয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল অথবা কোনো এক বা একাধিক হাসপাতাল ডেডিকেটেড রাখার বিষয়টি অ্যাকাডেমিক্যালি যতই বৈষম্যমূলক আর সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে স্বীকৃতরা বরাবরই বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও হয়তো পাবেন। কিন্তু কোনো এক বা একাধিক বিশেষ গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে যাতে সাধারণ মানুষ চিকিৎসাবঞ্চিত না হয়, তথা সংখ্যালঘিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সুচিকিৎসার জন্য যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পেতে বৈষম্যের শিকার না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

Mass uprising: Govt to request Interpol red notice to arrest fugitives

The government will request Interpol for red notice to arrest and bring back fugitives allegedly involved in the killings and genocide during the student protests of July and August, Law Adviser Asif Nazrul said today

1h ago