স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বুড়িমারীর সিলিকোসিসে আক্রান্ত শতাধিক পাথরভাঙ্গা শ্রমিক

চিকিৎসার অভাবে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকার সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত শতাধিক পাথরভাঙ্গা শ্রমিক।
Tofazzal Hossain
সিলিকোসিসে আক্রান্ত তোফাজ্জল হোসেন। ছবি: স্টার

চিকিৎসার অভাবে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকার সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত শতাধিক পাথরভাঙ্গা শ্রমিক।

তারা সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। এসব রোগী করোনা দুর্যোগকালে আরও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সিরিকোসিস আক্রান্তদের বাড়িতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।

অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে মারা গেছেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকার শতাধিক পাথরভাঙ্গা শ্রমিক। এ রোগে আক্রান্ত শ্রমিকরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, হারিয়ে ফেলেছেন কাজ করার শক্তি। খেয়ে না খেয়ে তাদের বাঁচতে হচ্ছে প্রতিক্ষণ মরণ যন্ত্রণায়।

প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে ছুটতে হচ্ছে সাহায্যের জন্য। কিন্তু, মিলছে না কোন সাহায্য-সহযোগিতা। অনেকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে শেষ করেছেন শেষ সম্বলটুকুও।

বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকার কামারেরহাট গ্রামের মৃত মমতাজ উদ্দিনের ছেলে পাথরভাঙ্গা শ্রমিক তোফাজ্জল হোসেন (৫৫) সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। সাত বছর ধরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য শেষ সম্বল বসতভিটার ৮ শতাংশ জমিও বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। আশ্রয় নিতে হয়েছে অন্যের জমিতে।

তোফাজ্জল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দারিদ্রের কারণে ১১ বছর আগে বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথরভাঙ্গা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রায় ৫ বছর কাজ করার পর সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হই। গেল ৭ বছর ধরে ধুকে ধুকে মরছি।’

‘আমরা এক সঙ্গে ১৫ জন কাজ করতাম। সবাই আক্রান্ত হই এ রোগে। আমাদের মধ্যে সাত জন ইতোমধ্যে মারা গেছে। বেঁচে আছি আমরা বাকি আটজন,’ জানিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘জানি না কখন হঠাৎ মৃত্যুর ডাক আসে।’

‘যখন চিকিৎসা করি তখন একটু ভালো থাকি। আর চিকিৎসা বন্ধ করলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কিন্তু, সবসয় চিকিৎসা খরচ যোগাতে পারছি না,’ জানালেন উফারমারা গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত পাথরভাঙ্গা শ্রমিক রশিদুল করিম (৪৫)।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বক্ষব্যাধি, রংপুর ও লালমনিরহাটে চিকিৎসা করতে গিয়ে আমার শেষ সম্বল এক বিঘা আবাদি জমি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আর বিক্রি করার মতো কিছুই নাই। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না।’

‘গত ৫ বছর ধরে আমি এ রোগে ভুগছি। আমার চারজন সহকর্মী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কাজ করার ক্ষমতা নেই শরীরে। তাই বাড়িতে বসে থাকতে হয় সারাক্ষণ।’

সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত ডাঙ্গীরপাড় গ্রামের পাথরভাঙ্গা শ্রমিক শাহিন ইসলাম (৪২) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রায় ১৪ বছর আগে যখন পাথর ভাঙ্গার কাজ শুরু করি তখন এ রোগের নামই শুনিনি। কোনো প্রকার সতর্ক ব্যবস্থা ছাড়াই পাথর ভাঙ্গার কাজ করতে গিয়ে আজ এ রোগে ভুগতে হচ্ছে।’

‘আমি গত আট বছর ধরে এ রোগে ভুগছি। আমার কয়েকজন বন্ধু এ রোগে মারা গেছেন। আমার অবস্থাও ভালো না। চিকিৎসা করাতে পারছি না। বাড়িতে থেকে ধুকে ধুকে মরছি। চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো আর কিছু দিন বেঁচে থাকতে পারতাম,’ যোগ করেন তিনি।

তাদের মতোই সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত পাথরভাঙ্গা শ্রমিক ডোলাপাড়া গ্রামের রেজাউল হক (৩৮), নাটারবাড়ি গ্রামের রহিমুদ্দিন (৪৬), ইসলামপুর গ্রামের আলতাফ হোসেন (৪৮) বামনদল গ্রামের নূর ইসলাম (৪৮), কামারেরহাট গ্রামের আফাজ উদ্দিনসহ আরও অনেকে জানালেন, সিলিকোসিস যেহেতু মরণব্যাধি তাই এ রোগে তাদেরকে মরতে হবে। চিকিৎসা করলে হয়তো সুস্থভাবে কিছুদিন বাঁচতে পারবেন। কিন্তু, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তারা কাজ করতে না পারায় পরিবারের লোকজনকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

এ দিকে, এখন যেসব শ্রমিক পাথরভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত আছেন তারাও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। তাদের অধিকাংশই ব্যবহার করছেন না মাস্ক। এ কারণে তাদেরকেও আস্তে আস্তে ধাবিত হতে হচ্ছে সিলিকোসিসে।

বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথরভাঙ্গার শ্রমিক নজরুল ইসলাম (৪২) বলেন, ‘আমাদের অনেকেই এখন গামছা বা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে পাথরভাঙ্গার কাজ করছি। অনেকে এখনো অসচেতন থাকছেন।’

‘গামছা বা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে কাজ করলে অস্বস্তি লাগে। তাই মাঝে মাঝে মাস্ক ব্যবহার করলেও প্রায়ই সময় খোলা রেখে কাজ করি,’ এমনটি জানালেন অপর শ্রমিক সিরাজুল ইলাম (৩২)।

‘আমাদের এ অঞ্চলে কাজের অন্য কোন ক্ষেত্র না থাকায় আমরা বাধ্য হয়েই পাথরভাঙ্গার কাজ করছি। মরণব্যাধি সিলিকোসিস সম্পর্কে জানি। কিন্তু, তারপরও কোনো উপায় নাই,’ জানালেন পাথরভাঙ্গা শ্রমিক সফিয়ার রহমান (৫২)।

সিলিকোসিস রোগে গত ৬ থেকে ৭ বছরে ৬৭ জন পাথরভাঙ্গা শ্রমিক মারা গেছেন জানিয়ে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে তালিকাভুক্ত ১০০ পাথরভাঙ্গা শ্রমিক আছেন, যারা সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন। তালিকার বাইরেও অনেক পাথরভাঙ্গা শ্রমিক আছেন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।’

‘বুড়িমারী স্থলবন্দরে ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক পাথরভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত আছেন। মাস্ক ব্যবহার করে পাথরভাঙ্গার কাজ করতে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছি নিয়মিত,’ যোগ করেন তিনি।

লালমনিরহাটে আরডিআরএস বাংলাদেশ’র অবসরপ্রাপ্ত যক্ষা ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. বিপুল চন্দ্র রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীর চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। অনেকে নিয়মিত চিকিৎসা নিলেও অধিকাংশ অনিয়িমিত রয়েছেন। টাকার অভাবে অনেকে ওষুধ কিনতে না পেরে চিকিৎসা নিয়মিত করতে পারছেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রয়োজনীয় মাস্ক ব্যবহার না করে পাথরভাঙ্গার কাজ করার শ্রমিক নাক-মুখ দিয়ে পাথরের ডাস্ট ভেতরে ঢুকে ফুসফুস আক্রান্ত করে পাথরভাঙ্গা শ্রমিকদের সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত করে। একসময় তাদেরকে মুত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।’

লালমনিরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করেনায় আাক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকি রয়েছে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত পাথরভাঙ্গা শ্রমিকদের। সিলিকোসিসে আক্রান্তরা শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল। তারা যদি করোনায় আক্রান্ত হন তাহলে কোনো রক্ষা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত ও সিলিকোসিস ঝুঁকিতে থাকা পাথরভাঙ্গা শ্রমিকদের আমরা বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়েছি। কোনোভাবে তারা যেন বাড়ির বাইরে না আসেন তা নিশ্চিত করছে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ।’

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি দল সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত পাথরভাঙ্গা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। মন্ত্রণালয় থেকে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও জীবন যাপনের জন্য আর্থিক সহায়তার প্রস্তুতিও রয়েছে।’

‘আমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছি বিষয়টি বেগবান করার জন্য। আর এ রোগে আক্রান্ত কেউ আমার কাছে আবেদন করলে আমি সহায়তা দিবো,’ বললেন জেলা প্রশাসক।

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago