১৫ আগস্টের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন শাহান আরা আবদুল্লাহ!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক শাহান আরা আবদুল্লাহ। গত ৭ জুন রাত সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২০১৮ সালের মে’তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই ভয়াবহ রাতের কথা দ্য ডেইলি স্টারের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন শাহান আরা আবদুল্লাহ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০টা।
বঙ্গবন্ধুর শ্যালক ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবার সবেমাত্র তাদের ২৭ মিন্টো রোডের বাসায় রাতের খাবার খেয়েছিল। রাতের খাবার শেষে সেরনিয়াবাত তার কক্ষে পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, পুত্রবধূ শাহান আরা বেগম ও ভাগ্নে শহীদ সেরনিয়াবাতের সঙ্গে দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
‘আমার এখনো মনে আছে, আমার শ্বশুর তার ছেলেদের বলছিলেন যে কীভাবে দেশ উন্নতি করতে পারে। তিনি আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য সমবায় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তবে, কে জানতো যে আমাদের সঙ্গে সেটা তার শেষ রাত হবে?’— এভাবেই দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সেই কালরাতের কথা বলছিলেন শাহান আরা বেগম।
রাত সাড়ে ১২টার পরে শাহান আরা বিছানায় ঘুমোতে যান। তিনি ও তার দুই ছেলে একই কক্ষে ছিলেন। আর মেয়ে অন্য কক্ষে।
‘বাবা-ছেলে (আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ) কথোপকথন শেষ করে কখন ঘুমাতে গিয়েছিলেন, তা ঠিক জানি না। হঠাৎ করেই অনবরত গুলির শব্দে জেগে উঠি। আমরা অবাক হয়ে যাই। গুলির প্রচণ্ড শব্দে রাতের নীরবতা ভেঙে যায়। সমস্ত দিক থেকে শিলাবৃষ্টির মতো গুলি আসতে শুরু করে।’
‘ছেলেদের নিয়ে শ্বশুরের ঘরে ছুটে গেলাম। পরিবারের অন্য সদস্যরাও ইতোমধ্যে সেখানে জড়ো হয়েছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় সবাই তখন বিস্মিত।’
‘সেই সময় আমার শাশুড়ি ফোন করে তার ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিষয়টি জানাতে বললেন স্বামীকে (আবদুর রব সেরনিয়াবাত)। বঙ্গবন্ধুকে জানাতে বললেন, “ডাকাতরা বাড়িতে হামলা করেছে।” টেলিফোনের অপর পাশ থেকে কী কথা এলো, তা পরিষ্কার ছিল না। এর মধ্যে আমি আরেকটি টেলিফোন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির নম্বরটি ডায়াল করি। মণি ভাই ফোন তুললেন।’
‘আমি মণি ভাইকে বললাম, “কিছু লোক আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। দয়া করে কিছু করুন।” তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তারা ইউনিফর্ম পরে আছে কি না। আমি তাকে বলেছিলাম, যেভাবে বৃষ্টির মতো বুলেট ছোড়া হচ্ছে, তাই ইউনিফর্ম পরে আছে কি না, দেখার কোনো উপায় নেই।’
‘অধৈর্য হয়ে আমার শাশুড়ি আবারও বঙ্গবন্ধুকে ফোন করতে বললেন। তখন শ্বশুর জবাব দিলেন, “মনে হচ্ছে তোমার ভাইকেও রেহাই দেওয়া হয়নি”।’
কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা (যারা গুলি চালাচ্ছিল) কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে এলো। শাহান আরার স্বামী আবুল হাসনাত অবশ্য তখন ঘরের ভিতরে ছিলেন না।
‘আমি তার (হাসনাতের) গলার আওয়াজ বেশ কয়েকবার শুনেছি। সশস্ত্র আক্রমণকারীরা যাতে না আসে, তা বলছিল। কিন্তু, তখন সে কোথায় ছিল জানি না।’
‘দেখে মনে হয়েছিল হামলাকারীরা বাড়িটি ভালোভাবেই জানে। কাঁচের দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকল এবং চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “হ্যান্ডস আপ”। টেলিফোনের সেটটি নষ্ট করতে তারা বিলম্ব করেনি। এরপরে তারা সবাইকে নিচতলায় নামিয়ে আনে। তারা আমাদেরকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলো।’
‘তাদের একজন জিজ্ঞাসা করলো, “এখনো উপরে আছে কেউ?” সেই সময় আমার শ্বশুরের মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পারি। বাড়ির ভেতরে কারা আছে, তা যেন না বলি, সেটিই তিনি বলতে চাচ্ছিলেন। হামলাকারীদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনি।’
‘সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবনায় আসায় মনে সাহস এলো। আমার জানা ছিল, এদের শায়েস্তা করার জন্য বঙ্গবন্ধু রয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপতি। ততক্ষণ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল না যে বঙ্গবন্ধু আর নেই।’
সেই ভয়াল রাতে ধানমন্ডি ৩২ এ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সবচেয়ে বড় রক্তপাত হয়েছিল। কিছু অসন্তুষ্ট সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিলেন। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
‘২৭ মিন্টো রোডের দৃশ্যপটটি দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। আবদুর রব সেরনিয়াবাত হামলাকারীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে? তোমরা কী চাও? কেন এখানে এসেছ?”। “আমাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই”— জবাব এসেছিল।’
‘সেই সময় আমি ১০ মাস বয়সী ছেলে সাদেক আবদুল্লাহকে (বরিশাল শহরের নবনির্বাচিত মেয়র) কোলে ধরে ছিলাম। বড় ছেলে সুকান্ত বাবু সিঁড়ি বেয়ে আমার মায়ের কাছে এসে তাকেও কোলে তুলে নিতে বললো। কিন্তু, যেহেতু সাদেক ইতোমধ্যে আমার কোলে, তাই আমি তাকে (সুকান্ত) নিতে পারিনি।’
‘তখন শহীদ সেরনিয়াবাত সুকান্তকে কোলে তুলে নিলেন। হামলাকারীরা ধরে নিয়েছিল যে পরিবারের সব সদস্য ঘরে উপস্থিত রয়েছে। তখন তারা নির্বিচারে গুলি শুরু করে দেয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমার শ্বশুরের (শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত) বুকে গুলি লাগে। আর আমার পিঠে।’
‘এরপর হামলাকারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারা যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, তখন ঘরের ভিতর থেকে আর্তচিৎকারের শব্দ শুনে ফিরে এসে আবারও নির্বিচারে গুলি চালায় তারা।’
‘আমার শ্বশুর ঠিক পাশেই ছিলেন। আমার কোলে তখনও ছেলে (সাদেক আবদুল্লাহ) ছিল। তাকে নিয়েই পড়ে যাচ্ছিলাম। আমি শ্বশুরের পেছনে শুয়ে পড়লাম। চার থেকে পাঁচটি গুলি পিঠে আমার লেগেছিল।’
‘হামলাকারীরা চলে গেলে কিছুক্ষণ পর রমনা থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ এসেছিল। তারা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সন্ধান শুরু করে।’
শাহান আরা পরে জানতে পেরেছিলেন যে তাদের একজন নিরাপত্তারক্ষী পুলিশকে ফোন করেছিলেন।
‘পুলিশ কর্মকর্তারা শ্বশুরের পালস পরীক্ষা করে তার হাত ছেড়ে দেয়। ততক্ষণে আমার স্বামী (আবুল হাসনাত) উপর থেকে নিচে নেমে এলেন। তিনি নিজেকে বাথরুমে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হামলাকারীরা সেখানে গিয়েছিল, কিন্তু অন্ধকারের কারণে তাকে দেখতে পায়নি।’
হাসনাত তার বাবার হাত ধরে পালস দেখলেন। দ্রুতই তিনি হাতটা নামিয়ে নিলেন। শাহান আরা তার স্বামীকে ছেলে সুকান্ত বাবুর অবস্থা দেখতে বললেন। তিনি (হাসনাত) সুকান্তকে আলাদা করার জন্য শহীদকে টানলেন। হঠাৎ একটা কর্কশ শব্দ তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তিনি নিশ্বাস ছাড়লেন।
সুকান্তের নাক থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাতের মরদেহও কাছাকাছি ছিল। একটি গুলি আরিফের মাথায় লেগেছিল। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাতের মরদেহও পাশে পড়ে ছিল।
আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, ভাগ্নে শহীদ সেরনিয়াবাত ও আত্মীয় আবদুর নইম খান রিন্টু— সবাই মারা গিয়েছিলেন।
শাহান আরা, তার স্বামী আবুল হাসনাত, ছেলে সাদেক, মেয়ে, শাশুড়ি ও দুই বোনজামাই এই গণহত্যায় বেঁচে গিয়েছিলেন।
‘আমি আজও তাদের মুখটি ভুলতে পারি না। কয়েক মুহূর্ত আগে তারা আড্ডা দিচ্ছিলো। অথচ কিছু সময়ের ব্যবধানে সকলের নিথর দেহ পড়ে আছে সামনে। সারা জীবনেও এই দৃশ্য ভুলতে পারিনি। প্রতিদিনই মনে প্রথম সন্তানসহ স্বজন হারানো বেদনা ভর করে’, বলেন শাহান আরা বেগম।
(সাক্ষাৎকারটি ২০১৮ মে’তে বরিশাল কালীবাড়ি রোডের বাড়িতে গিয়ে নেওয়া। ওই বছরের ১৫ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারে এটি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের বরিশাল প্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষ)
Comments