সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে না এই বাজেট
জাতীয় বাজেট উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যেকোনো অর্থমন্ত্রী প্রধানত তিনটি গুণাবলি প্রদর্শন করতে চান। সেগুলো হলো— দৃঢ়তা, কর্তৃত্ব ও কিঞ্চিত নীরস ভাব।
তিনি এই ধারণাটি দিতে চান যে, উচ্চাভিলাষী পপুলিস্ট রাজনীতির বিমূর্ততার নিচে রয়েছে সংখ্যার দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ; প্রধানমন্ত্রীর জনমুগ্ধকর বাক্যবাণের অন্তরালে বুক পকেটে ক্যালকুলেটর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দক্ষ ও বাস্তববাদী একজন মানুষ।
কিন্তু, প্রজন্মান্তরের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য হুমকি এবং অর্থনৈতিক ধ্বসের প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের জন্যে জাতীয় সংসদের মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে সম্ভবত সেই তিনটি বিষয়ই ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অধিক আশার বালির পাহাড়কে বাস্তবতার শীতল ঢেউয়ে ভেঙে না দিয়ে তিনি মরীচিকাকে দৃশ্যমান করতে প্রদর্শন করে গেছেন হাহাকারের নৈপুণ্য। মাস্ক পরে সান্তা ক্লজের মতো সেজে বিতরণ করে গেছেন কেবল শত শত সুসংবাদ এবং বলে গেছেন কাল্পনিক ত্রাতাদের কথা।
যে ব্যক্তি সামান্য পরিমাণেও এই বাজেট সম্পর্কে জেনেছেন, তিনিও অর্থমন্ত্রীর কথা শুনে ভাববেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি তেজি অশ্বের মতো ক্ষীপ্রতায় অগ্রে ধাবমান; এক যুক্তিহীন, অগাণিতিক হিসেবে তিনি বলে গেছেন আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হবে ঢাউস ৮ দশমিক ২ শতাংশ!
তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নের মতো খাতগুলোতে কমবেশি একই রকম বরাদ্দ দিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, এটা খুবই স্বাভাবিক একটা সময়!
কিন্তু, যথাযথ বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য যে খাতগুলো (স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও শিক্ষা) তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছিল, তাদের বরাদ্দ বেড়েছে অনুল্লেখ্য পরিমাণে।
করোনাভাইরাসকে দমিয়ে রাখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নেই। তাই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ লাফিয়ে বাড়ার কথা ছিল। অথচ এটি চলতি অর্থবছরের মূল বরাদ্দের চেয়ে মাত্র ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।
করোনা রোগীতে বিপর্যস্ত হাসপাতালগুলোর এমন অবস্থা যে সেখানে এখন সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা নিতে গিয়ে ফেরত যাচ্ছেন। যেহেতু আমরা জানি না যে মহামারিটির উচ্চগামী রেখাটি কখন সমতল হবে, তাই এখনই স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়ানোর তীব্র প্রয়োজন ছিল। চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বুক-কম্পিত ভয় নিয়ে মানুষ আর কত দিন বেঁচে থাকবে?
ঐতিহাসিকভাবে মনোযোগের দূরপ্রান্তে থাকা এই খাতটি অগ্রাধিকারের কেন্দ্রে নিয়ে আসার এক মোক্ষম মুহূর্ত ছিল এই মহামারি। আফসোস, তা হয়নি।
করোনাভাইরাসের এই তাণ্ডব দারিদ্র্যকে বাড়িয়েছে বহুগুণে এবং গত এক দশক ধরে দারিদ্র্য বিমোচনে যে অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছে, সেটি বাঁধাগ্রস্ত করতে দাঁড়িয়ে গেছে। সুতরাং, মহামারির এই দুঃসময়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর প্রতি সহায়তা বাড়াতে সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার তীব্র প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু, আগামী অর্থবছরের এই খাতের পরিমাণ জিডিপির আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে মাত্র তিন শতাংশ করা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, ১৬ কোটি মানুষের ৩৫ শতাংশ এখন দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। এমন অনিশ্চয়তায় এই দারিদ্র বৃদ্ধির প্রভাব কতটা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে, এমন অবস্থা থেকে প্রশ্ন আসে— সামাজিক সুরক্ষার বৃদ্ধি কি পর্যাপ্ত ছিল?
কৃষি ছিল এমন আরেকটি ক্ষেত্র যা আরও বেশি মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্য। কারণ, যেহেতু জনগণকে এই মহামারির সময়ও খাদ্যের সংস্থান করতে হবে। অথচ, চলতি অর্থবছরের তুলনায় এটি মাত্র ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে।
শিক্ষায়ও বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো উচিত ছিল। কারণ, যেহেতু চার কোটি শিক্ষার্থী শিগগিরই শ্রেণিকক্ষে ফিরতে পারবে না, তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের দিক থেকেই বেশকিছু সরঞ্জাম কেনা দরকার। এমনকি যদি প্রতিষ্ঠানে ক্লাসও শুরু হয়, সামাজিক দূরত্ব নিয়ম বজায় রাখার পাঠ দেওয়াটা প্রয়োজন। তাই সংক্ষেপে বলা যায়, এই খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ, শিক্ষার বাজেট বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।
এমন অনেকগুলো ক্ষেত্র ছিল যেখানে বরাদ্দ কমিয়ে উপরোল্লিখিত চারটি খাতে দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু, যেখানে কৃচ্ছতা সাধনের প্রয়োজন ছিল, সেখানে তিনি হয়েছেন বেহিসাবি।
পাবলিক সার্ভিস খাতের জন্য বরাদ্দ বিস্ময়করভাবে ৫৪ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
কেন তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দ ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ১৪৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করেছেন, তা বোধগম্য নয়।
২০২০-২১ অর্থবছরের সময় এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নির্ধারিত থোক বরাদ্দের চেয়ে এর পরিমাণ ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বরাদ্দ খেয়ে ফেলেছে বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যদি কোভিড-১৯’র ভ্যাকসিন ব্যাপকভাবে পাওয়া না যায়— যা পেতে হয়তো কমপক্ষে ২০২১ সাল চলে আসবে— তাহলে এই সময়ে যখন কারখানাগুলো এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে খুলবে না, তাহলে এত জ্বালানির কী প্রয়োজন?
এরপর আসে এক তুচ্ছ বিষয়। এই বিশাল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনার জন্য অর্থ আসবে কীভাবে? এখানেই অর্থমন্ত্রীর পকেট ক্যালকুলেটরটির অনুপস্থিতি পাওয়া যায়।
তবে, অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে বাজেট ঘাটতি রাখার বছরব্যাপী লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে আত্মবিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করেছেন, তা দুর্দান্ত।
তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি।
যদিও গত মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এক চিঠিতে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে বলেছেন— কর আদায়কারীরা আগামী অর্থবছরে মাত্র ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারবে।
তবুও, অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার চোখে কালো চশমা পরে নিয়েছেন এবং দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন এমন এক সময়ে যখন সম্ভবত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে থাকবে।
এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে অটোমেশনের দিকে এগিয়ে গেলে বিশাল সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু, সেখানেও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে তাকে দিশেহারা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
তিনি তার বাজেট বক্তৃতায় অটোমেশন সম্পর্কে গতবার যা যা বলেছেন, এবারও ছিল তার একটি পুনরাবৃত্তি। আমরা সবাই জানি যে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমরা এই খাতে কতটুকু অর্জন করেছি। তা খুব বেশি কিছু নয়!
ট্যাক্স প্রশাসনের অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের একমাত্র নতুন পদক্ষেপ হলো— যারা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন, তাদের জন্যে ২ হাজার টাকার ছাড়।
কালো টাকাতে পূর্ণ সাধারণ ক্ষমা দিয়ে রাজস্ব আয়ে তার অর্বাচীন আশা। যদিও অতীতের এমন পদক্ষেপ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
দেশ থেকে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যে পাচার করা হয়েছে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে, তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে করারোপ কাগজে-কলমে খুবই আশ্বাসপূর্ণ। তবে, কীভাবে এটি প্রয়োগ করা হবে সেই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বিবরণ ছিল না।
যদিও এটি প্রশংসনীয় যে তিনি ব্যক্তিগত করদাতাদের আয়ের শুল্কমুক্তির সীমা বাড়িয়ে এবং করের হার হ্রাস করে স্বস্তি দিয়েছেন, তবে যারা সর্বোচ্চ উপার্জন করেন তাদের জন্যও করের হার নামিয়ে আনার পদক্ষেপটি দুর্বোধ্য!
ধনীদের কোনো কর ছাড়ের দরকার নেই। আর এমন এক সময়ে, যখন রাজস্ব আদায়ের সব সুযোগ সংকীর্ণ, তখন কেন এমন একদল মানুষকে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে যা তাদের প্রয়োজন নেই?
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন মুঠোফোন একটি জরুরি পরিষেবা হয়ে উঠেছে, এমন সময়ে মুঠোফোন ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো একটি অন্যায্য সিদ্ধান্ত।
চার্টার্ড প্লেন, হেলিকপ্টার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লঞ্চের ভাড়ায়, গাড়ি ও জিপ রেজিস্ট্রেশনে, কসমেটিকসে এবং সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে স্বাগত। একই কথা প্রযোজ্য ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যাংকে থাকলে আবগারি শুল্কে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাবটির জন্যে।
একইভাবে দেশীয় চাষকে উৎসাহ দিতে এবং আমদানি-নির্ভরতা কমাতে পেঁয়াজ আমদানিতে স্বল্প হারের শুল্ক আরোপের প্রস্তাবকেও স্বাগত।
বেশিরভাগ রাজস্ব আদায়ের ভার মূল্য সংযোজন করের কাঁধে তুলতে বলা হয়েছে এই বাজেটে। অথচ এখন বেশিরভাগ গ্রাহকরা তাদের বাড়ির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখবেন কিংবা চাকরির হারানো বা বেতন কমার হুমকি মোকাবিলায় ব্যয় কমিয়ে ফেলবেন। এটিও অর্থমন্ত্রীর একটি অদূরদর্শী পদক্ষেপ।
এবার এনবিআর যে বাজেটে শক্তি যোগাতে ব্যর্থ হবে, তা জানা কথা। ফলে, অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক অর্থায়ন, ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং টাকা মুদ্রণের থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর বেশি নির্ভর করবেন।
শেষ দুটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে বিতাড়িত করবে এবং অন্যটি মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তুলতে পারে— আর এসব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সামান্য লক্ষণকেও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
আহা! অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার! যা এই বাজেটে সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এটিই সবচে কম আলোচিত। কয়েকটি ছোট ছোট পদক্ষেপের বাইরে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করা হয়নি যে এতে মনে হবে— সরকার অর্থনীতিকে আবার চাঙা করে তুলতে চায়।
অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আগামী অর্থবছরে— যা ১ জুলাই থেকে শুরু হবে— ‘চাকরি সৃষ্টি করে এমন সরকারি ব্যয়’র অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এটি কীভাবে করা হবে তার কোনো ছক নেই। পরিকল্পনা না করে কথা বলা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আগামী বছরের আর্থিক পরিকল্পনাটি ইকোনোমেট্রিক্সের কোনও অনুশীলন ছাড়াই খসড়া করা হয়েছিল?
সব মিলিয়ে, এই ভিন্ন সময়ে অর্থনীতিতে পরিচালন করার দৃঢ় প্রজ্ঞা ও দক্ষতা অঙ্কিত করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। তিনি যেন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে সেরাটি আশা করছেন। যা, অনেকটা জুয়া খেলার মতো!
Comments