করোনা বর্জ্যে আরেক বিপর্যয়
দেশে ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে গত ৩০ মে থেকে। আর, পাবলিক প্লেস বা জনসমাগম হয় এমন জায়গায় মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়ে ৫ জুন নির্দেশিকা হালনাগাদ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অর্থাৎ করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বাজার পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মাস্ক পরা। জীবন বাঁচাতে আপাতত এর বিকল্পও নেই। একই সঙ্গে, এসব সুরক্ষা সামগ্রী বা কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে।
মাস্ক, হ্যান্ড গ্লভস, হেড কভার, সু কভার, গগলস, ফেইস শিল্ড বা গাউনসহ যেসব সুরক্ষা সামগ্রী সাধারণ মানুষ ব্যাবহার করছেন, তার একটা বড় অংশ রাস্তা-ঘাটে উন্মুক্ত জায়গায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। বলা হচ্ছে, ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় সুরক্ষা সমাগ্রীতে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারে।
আবার বাসাবাড়িতে সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বর্জ্য। যেগুলোর ব্যবস্থাপনায় আলদা কোনো উদ্যোগ নেই সিটি করপোরেশনের। কোনো প্রকার সুরক্ষা ছাড়াই এগুলো সংগ্রহ, পরিবহন, ডাম্পিং বা ধ্বংসের কাজ করছেন হাজারো পরিচ্ছন্নতা কর্মী। যারা যেকোনো মুহূর্তে সংক্রমতি হতে পারেন।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট সুরক্ষা সামগ্রী মূলত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য। এসব পণ্য ভূমিতে বা পানিতে সাড়ে চার শ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাই মাস্ক বা প্লাস্টিকে তৈরি অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী ভূমি, জলাভূমি, নদী ও সমুদ্র দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। এমনিতেই বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। আবার, সাধারণ বর্জ্যের মতো যখন এগুলো উন্মুক্তভাবে পোড়ানো হয় তখন মারাত্মক বায়ু দূষণ ঘটে।
বিকল্প কোনো সমাধান আসার আগ পর্যন্ত মাস্ক বা অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী আমাদের ব্যবহার করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তাহলে সমাধান কোথায়?
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম পোশাক রপ্তানীকারক দেশ। অনেক কারখানা হয়তো চাইলেই দেশের ১৬ কোটি মানুষের ব্যবহারের জন্য কাপড়ের মাস্ক উৎপাদন করতে পারবে। যা বাজারে ছাড়লে লাভ ছাড়া লোকসান হবে না এবং মানুষের কর্মসংস্থানও হবে। এতে একদিকে যেমন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমবে, অন্যদিকে মানুষের সাশ্রয়ও হবে। কেননা, কাপড়ের মাস্ক ধুয়ে বার বার ব্যবহার করা যাবে।
মানুষকে আরও ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে। যেন তারা মাস্ক বা অন্যান্য কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলে আলাদা করে রাখেন।
এখন কথা হচ্ছে মানুষ সচেতন হলেই অথবা এসব বর্জ্য আলাদা করে রাখলেই কি সমাধান হয়ে যাবে? উত্তর আপাতত, না। কারণ, যারা এই বর্জ্য নেবেন তাদের এগুলো আলাদাভাবে নেওয়া, পরিবহন ও ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
তাই অতি দ্রুত সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলোকে তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে। ধরণভেদে প্রতিটি বর্জ্য তার উৎসেই আলাদা কারার ব্যবস্থা নিতে হবে। আলাদা আলাদা ভাবে সংগ্রহ, পরিবহন, ডাম্পিং ও ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাও।
অনেকে হয়তো বলার চেষ্টা করবেন, মানুষ সচেতন না। আমি এটা বিশ্বাস করি না। কারণ, মানুষ সবসময় বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। যখন বাসাবাড়ির বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা থাকবে এবং কেউ নিয়ম না মানলে তার বর্জ্য সিটি করপোরেশন নেবে না, তখন মানুষ নিজের গরজেই সব মেনে চলবেন।
অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। দেশ যখন অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করছে তখন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন মান্ধাতার আমলের থাকবে। আমার জানা মতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো উদ্যোগী হলে টাকার অভাব হবে না।
মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও খুবই নাজুক। দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৫ হাজার ৭০৯টি। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা বর্জ্য উৎপাদন হার প্রতিদিন বেড প্রতি ০.৯৪ কেজি। এছাড়া সারাদেশে প্রায় ১০ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর গত এপ্রিল মাসে মাস্ক, গ্লভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিনসহ অন্তত সাড়ে ১৪ হাজার টন চিকিৎসা বর্জ্য তৈরি হয়েছে। আরেক হিসেবে দেখা যায়, গেল মে মাসে শুধু ঢাকাতেই ৩ হাজার টনেরও বেশি কোভিড-১৯ সম্পর্কিত বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু, ঢাকার মতো মেগা শহরের বিপুল চিকিৎসা বর্জ্য ধ্বংসের জন্য শুধু মাতুয়াইলে একটি ইনসিনেটর আছে।
দেশের হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে মূলত হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাও আবার সীমিত পরিসরে ঢাকা, নারায়ানগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শহরে। অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য নিয়ম মাফিক বা পরিবেশ সম্মত উপায়ে সংগ্রহ, পরিবহন, ডাম্পিং বা ধ্বংস করা হয় না। আবার, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দষ্ট বিধিমালা আছে। যেখানে কালার কোড অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য পৃথকীকরণ, প্যাকেটজাতকরণ, পরিবহন, মজুদ ও বিনষ্টকরণের নিয়ম বলা আছে। কিন্তু সেই বিধিমালা কতটা মানা হচ্ছে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা বর্জ্য।
এই পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ বা হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্তাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্যসচিবসহ সংশ্লিষ্ট আট জন বরাবর আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। ৭২ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে ওই নোটিশে।
এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমাদের দেশের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে আইনি নোটিশ পাঠাতে হয়, আদালাতের শরণাপন্ন হতে হয়।
তবে আশা থাকবে সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বসে অতি দ্রুত একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবে। যাতে শুধু কোভিড-১৯ বা হাসপাতাল বর্জ্যই নয়, সব ধরণের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেই শুভ সূচনার অংশীদার হতে চায় ব্র্যাক।
ব্র্যাক তার ঢাকায় উৎপন্ন কোভিড-১৯ বর্জ্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনষ্ট করে। আর মাঠ পর্যায়ে যেসব কোভিড-১৯ বর্জ্য তৈরি হয় তার ব্যবস্থাপনা করা হয় স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের সহায়তায়।
পরিশেষে বলতে চাই, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল যদি হয়ে থাকে করোনা মহামারি, সেই পরিবেশ রক্ষায় যদি আমরা এখনই উদ্যোগী না হই, তাহলে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে আরেক বিপর্যয়।
ড. মো. লিয়াকত আলী: পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল এবং আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, ব্র্যাক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments