নারায়ণগঞ্জে করোনা হাসপাতালে দুই মাসেও চালু হয়নি আইসিইউ, পিসিআর ল্যাব বন্ধ

কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় রাজধানী ঢাকার পরই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা নারায়ণগঞ্জ। ঝুঁকি বিবেচনা করেই নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু এরপর দুই মাসেও চালু হয়নি হাসপাতালের ১০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব উদ্বোধনের দেড় মাস না যেতেই বন্ধ হয়ে গেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, কিট সংকটের কারণেই নমুনা সংগ্রহ ও পিসিআর ল্যাব বন্ধ রয়েছে। কিটের জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করা হয়েছে। কিট পেলে করোনাভাইরাস পরীক্ষা শুরু হবে। তবে, আইসিইউ কবে চালু হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
আজ রোববার দুপুরে শহরের খানপুর এলাকায় ৩০০ শয্যা হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে রাহুল সাহাকে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা বাবা করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। তারপর আমারও কয়েকদিন জ্বর, গলাব্যথা ছিল। এ জন্য পরীক্ষা করতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারি এখন নমুনা সংগ্রহ বন্ধ আছে। কবে চালু হবে সে বিষয়েও কেউ কিছু বলতে পারেনি।’
গত ১৯ জুন রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকার মোক্তার হোসেন (৩৫)। হাসপাতালে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে প্রায় সারাক্ষণই তার সঙ্গে ছিলেন বন্ধু মাসুদ চৌধুরী।
মাসুদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রথমে মোক্তার বাসায় আইসোলেশনে ছিল। কিন্তু গত ১৪ জুন শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে প্রথমে ভর্তি নিতে রাজি হয়নি। পরে কাউন্সিলর খোরশেদ ভাই ফোন দিয়ে বলে দেওয়ার পর ভর্তি নেয়। শুধু নাম জিজ্ঞাসা করে তাকে বেডে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। মোক্তারের তখন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নাই। তাই আরেক রোগীর কাছ থেকে অক্সিজেন খুলে এনে মোক্তারকে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর মোক্তারের কাছ থেকে খুলে আরেক রোগীকে দেওয়া হয়। অক্সিজেন খুলে নেওয়ার পরই মোক্তারের অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়। তখনই আমরা তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। রাতে ঢাকার মগবাজারে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জুন রাতে মোক্তার মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আইসিইউ নেই, অক্সিজেন নেই, চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলায় নারায়ণগঞ্জের হাসপাতালেই মোক্তার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখানে চিকিৎসা পেলে আজ আমার বন্ধু হয়তো বেঁচে থাকতো।’
আজ দুপুরে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে দ্রুত আইসিইউ চালু এবং নিয়মিত সর্বোচ্চ টেস্টের ব্যবস্থার দাবিতে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। বিক্ষোভ মিছিল করে আদালত চত্বরের প্রবেশ মুখে সমাবেশ করেন তারা।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও জেলা সিপিবির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতালে দুই মাসেও আইসিইউ চালু হয়নি। তার ওপর এখন নমুনা সংগ্রহ ও রিপোর্ট দেওয়াও বন্ধ রয়েছে। অনেকের পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট পেতে দেরি হয়েছে, আবার কেউ পায়নি। তাই দ্রুত আইসিইউ চালু, টেস্টিং কিটের সংকট দূর করে নিয়মিত সর্বোচ্চ টেস্টের ব্যবস্থা, হাসপাতালে চিকিৎসার মান বাড়ানোর দাবি আমরা জানিয়েছি। অন্যথায় আরও কঠোর আন্দোলন হবে।’
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে করোনা চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল ৪০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ১০ বেডের আইসিইউ ইউনিট চালুর কাজ শুরু হয়। পরে ১২ এপ্রিল সীমিত পরিসরে চালু করা হয় ফ্লু-কর্নার। সেখানে করোনা উপসর্গ আছে এমন রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। গত ১৩ এপ্রিল থেকে হাসপাতালটিতে শুরু হয় করোনা রোগী ভর্তি কার্যক্রম। বর্তমানে এখানে আইসোলেশনে ৫০ জন রোগী ভর্তি আছেন। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে আট জনের।
আরও জানা যায়, করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর আগে ১১ এপ্রিল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসকের করোনা শনাক্ত করা হয়। এরপর ১৫ এপ্রিল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক গৌতম রায়সহ ১৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে ডাক্তার, নার্সসহ ৭৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হন।
ইতোমধ্যে ৬৫ জন সুস্থ হয়েছেন। আর আট জন এখনও আইসোলেশনে আছেন। এর মধ্যে দুজন ডাক্তার, পাঁচ জন নার্স ও একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন।
৩০০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. গৌতম রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে পিসিআর ল্যাব ও নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে। এজন্য আমরা কিট চেয়ে আবেদন করেছি। আজও আমাদের জানিয়েছে পাঁচ হাজার কিট দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আইসিইউ নিয়ে কাজ করছি। এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না- কবে আইসিইউ চালু হবে। আমরা সকল সরঞ্জাম পেলেই শুরু করব। এ পর্যন্ত আমরা ৬০ থেকে ৬৫টি ভাগ সরঞ্জাম পেয়েছি। বাকি ৩০ ভাগের মধ্যে শয্যা ও আইসিইউ সামগ্রী রয়েছে। ভেন্টিলেটর চলে এসেছে। আমি আশাকরি আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে আইসিইউ চালু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন এখানে আইসিইউ নেই। তবে ওইরকম সাপোর্ট যদি কারো লাগে তাহলে তো আমি কারো জীবন নিয়ে কিছু করতে পারি না। এমন হলেও এখানে দেখে তারপর অন্যত্র পাঠানো হয়।’
অক্সিজেন নেই ও চিকিৎসা সেবার অবহেলার অভিযোগের বিষয়ে ডা. গৌতম রায় বলেন, ‘চিকিৎসা সেবায় অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়। কিন্তু অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা এখনো আছে। ইতোমধ্যে আমরা ২০০ অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য চাহিদা দিয়ে রেখেছি। বর্তমানে ৪৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। আর শয্যা আছে ১০০টি। সে হিসেবে আরও ৫৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন।’
উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৮৯২ জনের নমুনা সংগ্রহ করে চার হাজার ৬৪৩ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। করোনায় ১০৭ জন মারা গেছেন ও দুই হাজার ১৬০ জন সুস্থ হয়েছেন।
Comments