রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলোকে অবিলম্বে চালুর আদেশ দেওয়া হোক
‘রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলোকে অবিলম্বে চালুর আদেশ দেওয়া হোক’— এই মূল দাবি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৫৮ জন নাগরিক।
তাদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে: শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা ও তাদের করোনা ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়া; সময়মত পাট কিনে, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করে এবং পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে লোকসান কমানো হোক।
তারা পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন ও বহুমুখিকরণের মাধ্যমে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করার দাবিও জানিয়েছেন।
এছাড়াও, ‘গত কয়েক দশক ধরে লোকসানের অজুহাত দিয়ে একের পর এক পাটকল বন্ধ বা বেসরকারিকরণ করা হয়েছে’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘লোকসানের জন্য দায়ী মন্ত্রী, আমলা ও কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে বিচার করা হয়নি। আমরা সেজন্য লোকসান ও দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করি।’
এতে আরও বলা হয়, গত ২৮ জুন লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ২৬টি পাটকল বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিককে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ দেওয়ার ঘোষণা করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী জানিয়েছেন পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করার পরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে সেগুলোকে আধুনিকায়ন করে আবার উৎপাদনমুখী করা হবে।
তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন।
অথচ ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে এক মতবিনিময় সভায় পাটমন্ত্রী নিজেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে লোকসানের পেছনের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন।
এ থেকে একটা বিষয় অন্তত পরিষ্কার যে লোকসানের কারণগুলো সরকার নিজেও জানতো এবং জেনেশুনেই এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই একে পরিকল্পিত লোকসান হিসেবেই দেখতে হবে।
বিবৃতি মতে, পাটশিল্পের লোকসান কেন হয়েছে এ সংক্রান্ত যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে বার বার লোকসানের যে কারণগুলো উন্মোচিত হয়েছে সেগুলো দীর্ঘ ৪০ বছরেও সমাধান করা হয়নি।
সরকার যথাসময়ে অর্থবরাদ্দ না দেওয়ায় এই পাটকলগুলোকে বিলম্বে অনেক বেশি দামে কাঁচা পাট কিনতে হয়। ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম পাট কেনায় পাটকলগুলোর সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহৃত হয় না এবং উৎপাদনও হয় সক্ষমতার ও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। এভাবে বছর বছর লোকসানের পাল্লা ভারী করা হয়েছে।
প্রয়োজন অনুসারে মেশিনপত্র আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করলে যেখানে উৎপাদন বাড়ানো যেত সেই পথে না হেঁটে সরকার বিভিন্ন সময়ে কারখানা বন্ধ রাখা, মজুরি না দেওয়া, বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অচলাবস্থা তৈরি করেছে।
যেখানে পাটজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনার বাস্তব চাহিদা আছে, সেখানে যন্ত্রপাতি নবায়ন, পাট গবেষণার ফলাফল ব্যবহারের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিগত দশকে যখন সারা পৃথিবীতে প্লাস্টিক সামগ্রীর বিপরীতে পরিবেশ-বান্ধব পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানো হয়নি, বরং তাদের আয় কমে যায়।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিজেএমসি, মিল ব্যবস্থাপনা, ও ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনা সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের আধিপত্য। যার কারণে সময়মত কাঁচা পাট কেনায় গাফিলতি ও উচ্চমূল্যে কেনার মতো ঘটনা ঘটে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘এরা সবাই পাটকলের লোকসানের সুবিধাভোগী’।
সেজন্য পরিকল্পিতভাবেই এই লোকসানকে বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা হয়েছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, জবাবদিহিতাহীন ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এই পাটখাতের উদ্ধারকর্তা হিসাবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৪ সালে।
বিশ্বব্যাংক ঋণে পরিচালিত এই উন্নয়ন কর্মসূচিতে পাটশিল্প নবায়ন, বৈচিত্র্যকরণ বা সম্প্রসারণের কোনো কর্মসূচিই ছিল না; ছিল ঋণের টাকায় শিল্প বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কর্মসূচি।
সেই মোতাবেক এরপর যত সরকার এসেছে সবাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্পকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করেছে।
‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর হাতে জমি আছে অনেক’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প অচল করে বন্ধ করার পেছনে সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের মধ্যে এই জমি বিতরণের সম্পর্ক আছে বলে আমরা মনে করি।’
‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের জন্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। অথচ এর অনেক কম টাকা দিয়ে এই কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও তাদেরকে লাভজনক করা সম্ভব ছিল। আর শ্রমিকদের সব পাওনা পরিশোধের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা অতীতের অসংখ্য প্রতারণার কারণে কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে আমরা সন্দিহান।’
করোনাকালে কর্মহীন হয়ে যাওয়া বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন এই শ্রমিকেরা যখন কর্মহীন হয়ে যাবেন তারা জানবেন না কবে নতুন করে পাটকল খুলবে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কিংবা পিপিপি এর মাধ্যমে এ পাটকলগুলোর কোনটি কোনটি খুললেও সবাই কাজ পাবেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই, বেতন ভাতাও অনেক কমে যাবে।’
‘এছাড়া, পাটকলগুলোর ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিকের বাইরেও রয়েছে বিপুল সংখ্যক দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিক, তারাও কোনরকম গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেক ছাড়াই কাজ হারিয়ে পথে বসবে।’
‘এতগুলো পরিবারকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্ত কখনোই জনবান্ধব হতে পারে না। এই চেষ্টাতে যেমন পাটকল শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তেমনি পাট উৎপাদনকারী কৃষকেরাও অল্প দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হবার সম্ভাবনাও বাড়বে, যেহেতু এর ফলে বেসরকারি পাটকলগুলো সিণ্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে কাঁচা পাটের বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়ে যাবে।’
‘করোনাকালে যখন পরিবেশ-বান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠার তাগিদ বাড়ছে তখন সরকার পরিবেশ-বান্ধব পাটশিল্প সংকুচিত করে পরিবেশ-বিধ্বংসী শিল্প প্রতিষ্ঠার পেছনে বিশাল বাজেট বরাদ্দ করছে। অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য সারা পৃথিবী যখন কর্মসংস্থান তৈরির দিকে মনোযোগ দিয়েছে তখন বাংলাদেশ সরকার ঠিক এই সময়ে প্রত্যক্ষ শ্রমিক প্রায় ২৫ হাজার এবং পরোক্ষ আরও ২৫ হাজার শ্রমিক এবং তাদের পরিবারকে কর্মহীন করে উলটোপথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
এত শ্রমিকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের পরিবারের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ও বাসস্থানের ঝুঁকি। এই ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু পাটখাতের জন্য আত্মঘাতী নয়, বরং এই মুহূর্তে যখন রপ্তানি ঝুঁকিতে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে দেশ তখন এমন সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতির জন্যও আত্মঘাতী’ বলে মনে করেন তারা।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়েমা খাতুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাদাফ নূর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌভিক রেজা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও সমাজ সংগঠক খুশী কবির। ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ইরতিশাদ আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, আইনজীবী সারা হোসেন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন, শুদ্ধস্বরের প্রকাশক ও সম্পাদক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী ও লেখক-সংগীতশিল্পী অরূপ রাহী।
Comments