হলি আর্টিজান হামলার ৪ বছর: বিভীষিকাময় এক রাত

ফাইল ছবি

২০১৬ সালের রমজানের শেষের দিকে এক শুক্রবার সন্ধ্যা। হলি আর্টিজান বেকারিতে শান্ত পরিবেশ।

চারপাশে গুলশানের উঁচু দালানের ভিড়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে অতিথিরা কফি, ক্রাইসেন্টস, ব্যাগেলস, পিজ্জা এবং প্যাস্ট্রি অর্ডার করছিলেন। প্রায় ২০ জন ওয়েটার নিরন্তর ছুটছেন অর্ডার টেবিলে পৌঁছে দিতে।

গুলশান লেকের ঠিক পাশেই বিরাট বিরাট জানালা আর সুন্দর লনের পশ্চিমা ধাঁচের দোতলা ক্যাফেটি দেশি-বিদেশি সবারই পছন্দের জায়গা ছিল।

রাত ৮টা। নিচতলায় আট জন ইতালীয় ব্যবসায়ী আরেক ইতালীয় নাগরিক নাদিয়া বেনেডেটির বিদায় উপলক্ষ্যে নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন।

এর কয়েক গজ দূরেই ফারাজ আইয়াজ হোসেন তার বন্ধু অবনিতা কবির ও তারশি জৈনের সঙ্গে ছিলেন।

হলের এক প্রান্তে টেবিলে বসে মাকোটো ওকামুরা আরও ছয় জাপানি নাগরিকের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করছিলেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম পরিবার নিয়ে তার মেয়ের জন্মদিন উদযাপন করছিলেন।

সকালেই কানাডা থেকে ঢাকায় ফেরা তাহমিদ হাসিব খান তার বন্ধু ফাইরুজ মালিহা ও তাহানা তাসমিয়াকে নিয়ে লেকের ধারে গাজেবোতে বসে ছিলেন।

রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে ব্যাগসহ পাঁচ জন যুবক ক্যাফের দরজায় আসে। ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে গার্ড নূর আলম তাদের পরিচয় জানতে চান। তারা তাকে অগ্রাহ্য করে এগুতে থাকলে গার্ড জিজ্ঞাসা করেন, ‘কোথায় যাবেন?’

প্রশ্ন শুনে তাদের মধ্যে একজন আলমের ডান চোখে ঘুষি মেরে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘গেট লস্ট’।

তারা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ধ্বনি দিতে দিতে ক্যাফে প্রাঙ্গণে নেমে পড়ে।

কার্গো প্যান্ট, জিন্স আর টি-শার্ট পরে তারা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। সেমি-অটোমেটিক রাইফেল, গ্রেনেড এবং রামদা নিয়ে তারা কাছাকাছি দাঁড়ায় এবং আল্লাহু আকবার বলতে বলতে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে।

চারদিক চিৎকার আর কান্নার শব্দে ডুবে যায়। উপস্থিত সবাই আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে টেবিল আর চেয়ারের নিচে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে।

বন্দুকধারীরা বলেন, ‘ভয় পাবেন না। আমরা মুসলমানদের হত্যা করবো না। টেবিলের নিচ থেকে উঠুন।’

এই জিম্মি পরিস্থিতির অবসান হয় প্রায় ১২ ঘণ্টা পর। তবে সেখানে জীবন দেন নয় জন ইতালীয়, সাত জন জাপানি, দুজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি বংশদ্ভুত আমেরিকান এবং একজন ভারতীয়।

প্রথম ইতালীয়দের, এরপর অন্য বিদেশিদের গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারেনি। তারা জায়গাটিতে কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে বন্দুকধারীরা গুলি চালায় এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে মারা যান দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

এরপর শুরু হয় প্যারা-কমান্ডোদের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। কমান্ডো অভিযান শেষে দেখা যায় নির্মমভাবে তারা হত্যা করেছে ২০ জনকে। যাদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি নাগরিক।

২০১৬ সালের ১ জুলাই ঘটে এই গণহত্যা।

ক্যাফেটির একজন সহকারী শেফ দেলোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটা একটি ভয়াবহ রাত ছিল। আমি তো ভেবেছিলাম আর বাঁচবো না।’

বিদেশিদের হত্যা করার মিশনে তারাপ এসেছে জানিয়ে নিব্রাস সবাইকে বলেন, ‘ভয় পাবেন না। আমরা আপনাদের হত্যা করব না। আমার কথা শুনুন।’

দেলোয়ার বলেন, ‘গুলি আর চিৎকারের শব্দে আমি ভয়ে ভয়ে রাতটি কাটিয়েছি। এখনও সেই রাতের কথা মনে পড়লে ভয়ে কেঁপে উঠি।’

আমেরিকার এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ২০ বছর বয়সী ফারাজ তার বন্ধু বাংলাদেশি বংশদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক অবনিতা এবং ভারতীয় নাগরিক তারশির সঙ্গে নিহত হন।

রাত কেটে গেলে বন্দুকধারীরা বেশ কয়েকজন জিম্মিকে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে দেয়। কিন্তু তারা সেখানকার কর্মীদের মুক্তি দেয়নি। কমান্ডো অভিযানে পাঁচ সন্ত্রাসী এবং ক্যাফের এক শেফ নিহত হন। আহত আরেক কর্মী মারা যান হাসপাতালে।

প্রায় দুবছর তদন্তের পর, পুলিশ গত বছরের ২৩ জুলাই এই ঘটনায় জড়িত ২১ জঙ্গির মধ্যে আট জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়। বাকি ১৩ জঙ্গি বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন।

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত এই হামলায় জড়িত সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং একজনের দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় মুক্তি দেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন রাশ, হাদিসুর রহমান, রকিবুল হাসান রিগান, মো. আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন।

আদালত মামলার অভিযোগ থেকে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানের নাম খারিজ করে দিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

All 3 major parties backed Yunus' leadership: press secretary

Expressed support for a free, fair, and peaceful election under his administration, says Shafiqul Alam

15m ago