‘গণমাধ্যম হারাল স্বাধীন সাংবাদিকতার একটি শক্ত ভিত্তি’
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের স্মরণে আজ রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় স্মরণসভা ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। যা দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন ও ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে।
লতিফুর রহমানের নাতি জারিফ আয়াত হোসেনের সঞ্চালনায় আয়োজনে কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম।
লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্মরণ সভায় এভাবে কথা বলতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘এই মানুষটি আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। আমার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে একটি স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করার। তিনি আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তিনি আমার শক্তির উৎস, একজন বন্ধু, একজন ভাই, একজন সহায়তাকারী, একজন উপদেষ্টা, একজন পথপ্রদর্শক।’
লতিফুর রহমান ব্যবসার দুনিয়ার মানুষ ছিলেন। পত্রিকার স্বাধীনতায় ব্যবসায়ী পরিকল্পনা কীভাবে কাজে আসতে পারে সে বিষয়ে লতিফুর রহমানের ভাবনা সম্পর্কে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘মিডিয়া তার জগত ছিল না। তিনি বলতেন, এটাকে নিয়েও ব্যবসায়িকভাবেই চিন্তা করতে। আমাকে বলতেন, “মাহফুজ, তুমি যদি স্বাধীন সংবাদপত্র চাও, তাহলে তোমার স্বাধীন ব্যবসা পরিকল্পনাও থাকতে হবে। প্রতি বছর যদি আমার কাছে বা বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের কাছে পত্রিকা চালানোর জন্য টাকা চাইতে আস, তাহলে সেটা আমাদের জন্য সুখকর হবে না। কিন্তু, পত্রিকাটিকেই যদি তুমি লাভজনক করতে পারো, তাহলে তুমি যেমন স্বাধীন পত্রিকা চাও, আমরা সবাই যেমন স্বাধীন পত্রিকা চাই, তেমন পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে”।’
মিডিয়া জগতের মানুষ না হয়েও স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতি লতিফুর রহমানের আসক্তি কীভাবে তৈরি হলো?— এই বিষয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি তার গভীর অনুরাগের কারণেই তিনি স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তিনি কখনও রাজনীতিতে জড়াননি। রাজনীতিতে তার আগ্রহও ছিল না। কিন্তু, তিনি অনুভব করতেন সকলের জন্য, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন। আর গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন গণমাধ্যম। তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন বলেছেন, আপনার অন্যান্য ব্যবসার ক্ষতি করে এই পত্রিকা কেন এভাবে চালাচ্ছেন। তাদের তিনি উত্তর দিয়েছেন, “আমি যেসব ব্যবসা চালাচ্ছি, তার মধ্যে এগুলো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ”।’
‘তিনি এবং পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যরা সম্পূর্ণ সম্পাদকীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী থেকেছেন সূচনাকাল থেকেই। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার ভেতরে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রত্যাশা স্বাভাবিক। কিন্তু, একজন ব্যবসায়ী হয়েও লতিফুর রহমানের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রত্যাশা তাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়’, বলেন তিনি।
স্বাধীনভাবে দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিকদের কাজ করতে দেওয়ার ফলে এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতি বা প্রকাশিত মতামতের কারণে বিভিন্ন সময় লতিফুর রহমানকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘অনেক সময় তিনি ব্যবসায়িক চুক্তি করতে পারেননি কিংবা কারখানা তৈরির অনুমোদন পেতে দেরি হয়েছে বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কিংবা তার ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আমার মনে আছে, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সেখানে তাকে বিভিন্নজনের বিভিন্ন কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু, তিনি কখনও আমাকে বলেননি, মাহফুজ, প্রতিবেদনগুলো একটু হালকাভাবে লিখ বা একটু ভিন্নভাবে লিখ। তিনি এমনও কখনও বলেননি, মাহফুজ তুমি আমার কাজে সমস্যা তৈরি করছ।’
দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিষয়ে তিনি কখনও কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করতেন না উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘কেউ যদি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদন নিয়ে তাকে কিছু বলত, তাহলে তার উত্তর হতো, “এ বিষয়ে আপনি সম্পাদকের সঙ্গে কেন কথা বলছেন না কেন, পত্রিকাটি তিনি চালান। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলা উচিৎ না।” একটি স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতিষ্ঠায় তার সহযোগিতার জন্য তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’
লতিফুর রহমানের দেশপ্রেম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই মানুষটি অত্যন্ত দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের উন্নতির জন্য কাজ করতেন। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি খুব গর্ব করে বলতেন, “আমার কোনো সন্তানের বিদেশি পাসপোর্ট নেই। এমনকি আমার বা আমার স্ত্রীরও নেই।” তিনি গর্ব করে বলতেন, “আমি আমার সন্তানদের পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠিয়েছি। যেদিনই পড়া শেষ হয়েছে, সেদিনই তাদের দেশে ফিরে এসে দেশের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছি”।’
বাংলাদেশের উন্নয়নে তার নিরন্তর প্রচেষ্টার ব্যাপারে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘অনেক জায়গাতেই তার সঙ্গে আমি উপস্থিত থেকেছি। বিদেশি ব্যবসায়ী বা কূটনৈতিক যার সঙ্গেই তার কথা হয়েছে তাকেই তিনি উদ্বুদ্ধ করতেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে। বিভিন্ন খাতে কাজের জন্য বাংলাদেশের মানুষের ওপর তার বিশ্বাস ছিল অনেক বেশি। যার কারণে তিনি বিদেশি পরামর্শক নিয়োগে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। অন্য উপায় না থাকলেই কেবল তিনি বিদেশি পরামর্শক নিতেন। তিনি সবসময় বলতেন, “আমি যদি আমাদের দেশের মানুষকে প্রশিক্ষিত না করি, তাহলে সব সময়ই আমাকে অন্য দেশের মানুষের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অন্যদের থেকে পরামর্শ নিতে পারি। কিন্তু, আমি আমার অর্থ এবং সময় ব্যয় করতে চাই আমার নিজের দেশের মানুষদের যত দ্রুত সম্ভব প্রশিক্ষিত করে তুলতে”।’
‘আমি আমার একজন ভাই হারালাম, বাংলাদেশ একজন মহান উদ্যোক্তা হারালো এবং গণমাধ্যম হারাল স্বাধীন সাংবাদিকতার একটি শক্ত ভিত্তি। আমি দোয়া করছি, তিনি যাতে জান্নাতবাসী হন। আমি তার সঙ্গে কাজ করতাম প্রতিটি দিন। সেটা আমি মিস করব।’
উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই সকাল ১১টার দিকে কুমিল্লায় পৈত্রিক বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লতিফুর রহমান (৭৫)। ওই দিন রাতে তাকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন:
Comments