প্রবাস

ইতালির গণমাধ্যমে বাংলাদেশ

ইতালির সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা লা রিপাবলিকা ও ইল মেসেজেরোর (দ্য মেসেঞ্জার) আজকের (৯ জুলাই) সংবাদ শিরোনামেও ‘ঢাকায় ভুয়া স্বাস্থ্যসনদ ব্যবসা’।

ইতালীয়দের কাছে বাংলাদেশি কমিউনিটির সুনাম অনেক দিনের। বাংলাদেশিরা ভালো শ্রমিক। বৈধভাবে বাস করতে এবং উপার্জন করতে পছন্দ করে।

অভ্যন্তরীণ কিছু ‘ঝামেলা’র বাইরে বাংলাদেশি কমিউনিটি মূলত সাদাসিধে একটা কমিউনিটি হিসেবে পরিচিত ইতালিতে। যে কারণে চাকরির ক্ষেত্রে ইতালীয় মালিকরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

সাধারণ ইতালীয় ও প্রশাসনের চোখে বাংলাদেশিদের প্রতি সব সময় সহানুভূতি দেখা যায়। কিন্তু, হঠাৎ করে দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করেছে।

ইতালির একটা প্রথম সারির দৈনিক প্রধান আইটেম করেছে বাংলাদেশফেরত প্রবাসীদের প্রসঙ্গ। সেখানে খুব পরিষ্কার করে লেখা হয়েছে, ইতালিতে ফের করোনা ঝুঁকি তৈরি করছে বাংলাদেশিরা।

পত্রিকাটি লিখেছে, বাংলাদেশ থেকে সম্প্রতি ইতালিতে আসা অভিবাসীদের ১৩ শতাংশের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।

ফেব্রুয়ারির শেষে ইতালিতে করোনার সংক্রমণ বাড়লে কিছু বাংলাদেশি দেশে চলে যায়। তাদের কেউ কেউ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন বছরের শুরুর দিকে দেশে যাবেন। কিছু মানুষ ইতালিতে লকডাউনের কারণে বেকার হয়ে দেশে যেতে বাধ্য হন। আর কিছু মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন।

তারা দেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন। এর মধ্যে তাদের অনেকের ইতালীয় ডকুমেন্ট নবায়নের সময় হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ গ্রীষ্মকালীন চাকরি বা ব্যবসা করেন। কিন্তু, করোনার কারণে ইতালিতে আসার নিয়মিত এয়ারলাইনগুলোর ফ্লাইট বন্ধ থাকায় তারাও পড়েন বিপাকে। প্রায় লাখ টাকা বাড়তি খরচ করে প্রাইভেট প্লেনে চড়ে তারা ইতালি ফিরতে শুরু করেন।

গত দুই সপ্তাহের মধ্যে চারটি ফ্লাইট রোম ও মিলানোয় আসে ঢাকা থেকে। প্রতি ফ্লাইটে আড়াই শর বেশি অভিবাসী আসেন।

ইতালির প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথমে বিষয়টি খুব বেশি আমলে নেয়নি। তারা বাংলাদেশ থেকে আগতদের হাতে ঢাকার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্যসনদ দেখে ভরসা করেছিল। তারা ১৪ দিনের সাধারণ হোম কোয়ারেন্টিন করার নির্দেশনা দিয়ে আগতদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়।

কিন্তু, হোম কোয়ারেন্টিনের নির্দেশ অমান্য করে অনেক অভিবাসী কমিউনিটিতে সাধারণ মেলামেশা শুরু করেন। কেউ কেউ চাকরি, ব্যবসায় যোগ দেন।

এর মধ্যে ইতালির নিয়ন্ত্রিত করোনা সংক্রমণ হঠাৎ বাড়তে শুরু করে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। ইল মেসেজেরো (দ্য মেসেঞ্জার) পত্রিকা লিখেছে, ঢাকা থেকে প্রাইভেট ফ্লাইটে অন্তত ছয় শ করোনা পজিটিভ মানুষ ইতালিতে প্রবেশ করেছেন। তারা নতুন করে ইতালিতে করোনা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

পত্রিকাটি বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের বরাত দিয়ে লিখেছে, তারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্যসনদ কিনেছেন। কেউ কেউ আরও বেশি টাকা খরচ করে করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন। সেখানে নেগেটিভ ফল এলেও ইতালির পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছে।

এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে। ইতালির সব সংবাদ মাধ্যমের মূল প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশ। টকশোগুলোতেও কথা বলার প্রধান আইটেমে পরিণত হয় বাংলাদেশ। তাৎক্ষণিকভাবে ইতালীয় প্রশাসন ঢাকার সব ফ্লাইট সাময়িকভাবে বাতিল ঘোষণা করে।

রোমের আশপাশে বসবাসকারী প্রায় ৩৫ হাজার বাংলাদেশির জন্য করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।

হোম কোয়ারেন্টিন অমান্য করলে অর্থ জরিমানাসহ হাজত খাটার বিধানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে অভিবাসীদের রেসিডেন্ট পারমিট বাতিল করার ব্যবস্থা।

যারা হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন, তাদের নিয়মিত খোঁজ রাখতে শুরু করে প্রশাসন। এর মধ্যে তিন বাংলাদেশি অভিবাসীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাদের নাম উল্লেখ করে প্রশাসন জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সম্প্রতি ফেরা তিন অভিবাসীকে তাদের ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। তাদের সন্ধান পেলে পুলিশকে জানাতে বলা হয়েছে।

এ দিকে ভুয়া স্বাস্থ্যসনদ নিয়ে ইতালিতে আসা ও সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার সংবাদে ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন বাংলাদেশি অভিবাসীরা। অনেকে নতুন করে বেকার হতে শুরু করেছেন। কর্মস্থল থেকে তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে। কোনো কোনো মালিক বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে করোনা পরীক্ষার সনদ নিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে বলেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিবাসী জানিয়েছেন, তার অন্যান্য সহকর্মীরা মালিককে বলেছে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে না পাঠালে তারা চাকরি করবে না।

পথে-ঘাটে, গণপরিবহনে বাংলাদেশিরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাদের দিকে বিশেষ নজরে তাকানো হচ্ছে। যেমনটা হয়েছিল করোনা সংক্রমণের শুরুতে চীনের নাগরিকদের প্রতি। সে সময় ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চীনারা হামলারও শিকার হয়েছিলেন।

ঢাকার সঙ্গে সাময়িক উড়োজাহাজ যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণার পর ইতালিতে ১৫২ অভিবাসী আসেন কাতার এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িংয়ে। তাদের কাউকে গ্রহণ করেনি ইতালি। সবাইকে ওই একই ফ্লাইটে ঢাকার পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে গিয়ে যেসব অভিবাসীর ইতালীয় ডকুমেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে, ইতালির সরকার তাদের ডকুমেন্টের মেয়াদ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

কিন্তু, উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সবাই নতুন করে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলেন। আগস্টের মধ্যে ইতালিতে প্রবেশ করতে না পারলে তাদের ভাগ্যে কী আছে, তা এখনি বলা সহজ নয়।

এই মুহূর্তে ইতালি অভিবাসী বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার জন্য কড়া কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন। ইতালীয় স্বাস্থ্যবিভাগের পাশে দাঁড়ানো উচিত বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু, এখন পর্যন্ত এমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। বরং ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত সেখানে কর্মরত সাংবাদিকদের বলেছেন, ইতালীয় পত্রিকায় ভুলভাবে বাংলাদেশের সংবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন:

ভুয়া করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট: ইতালির পত্রিকার শিরোনামে বাংলাদেশ

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago