ভাঙা স্বপ্নের কাফেলা

আমানউল্লাহ এরশাদ তার দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন রাজধানীর বনশ্রীতে। দুই ছেলেই পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাদের পড়াশুনার খরচসহ মাথা গোঁজার জন্য ছোট একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকার মতো যথেষ্ট পরিমাণ আয় করতেন তিনি।
কিন্তু তার জীবন ওলটপালট হয়ে যায় মহামারি শুরু হওয়ার পর। গার্মেন্টসের বাতিল পণ্য কেনা-বেচার ব্যবসা করে তার যে আয় হতো তা বন্ধ হয়ে যায়। আয় না থাকলেও তাকে পরিশোধ করতে হয়েছে বাসার পুরো ভাড়া। সঙ্গে ভাড়া দিতে দেরি হওয়ায় তাকে লাঞ্ছিত করেছে বাড়িওয়ালা।
ব্যবসায়ে সুদিন ফেরার আশা নিয়ে আর অপেক্ষা করতে পারলেন না আমানউল্লাহ এরশাদ। দীর্ঘ দিনের লকডাউনে বিপর্যস্ত ৪৪ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী তাই ভাড়া বাসার মালামাল গুছিয়ে ১ জুলাই সপরিবারে চলে যান দোহারে, নিজের পৈতৃক ভিটায়।
তিনি বলেন, ‘এই শহরে টিকতে পারলাম না। সেই গ্রামে ফিরতে হয়েছে, যেখানে আয় রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নাও হতে পারে। তবে বাসা ভাড়াটা অন্তত দিতে হচ্ছে না।’
আমানউল্লাহ এরশাদের পরিবারের মতো আরও অনেকেরই আয় বন্ধ হয়েছে এই মহামারির কারণে। যেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে মাসের শেষে বাসা ভাড়া পরিশোধ করা তাদের কাছে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই, স্বপ্নগুলো শহরের নালায় ছুড়ে ফেলে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন নিজ নিজ গ্রামে।
৯ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত পরিচালিত বিশ্বের সেরা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে, মে মাসে সাধারণ ছুটি চলাকালীন সময়ে শহরাঞ্চলে পরিবারগুলোর গড়ে আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। দুই হাজার ৩১৭ জনের ওপর করা এই জরিপের ফলাফলে দেখা যায় শহরের বাইরে মহামারির প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, শহরের বাইরে কাজহীন ছিলেন ২৮ শতাংশ মানুষ।
শহর থেকে মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাড়িওয়ালারা।
শহর আর অনলাইনের দেয়ালে দেয়ালে বেড়েই যাচ্ছে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন। অনেক বাড়ির ভাড়া যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে। তবুও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না বলে দাবি করছেন বাড়িওয়ালারা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চাকরি কমে যাওয়া এবং বেতন কাটার কারণে দ্রুত বাড়বে নতুন দরিদ্রদের সংখ্যা। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আরও গভীর হয়ে উঠবে সংকট।
পাঁচ হাজার ৪৭১ জনের ওপর পরিচালিত অন্য এক জরিপ থেকে জানা যায়, আগে দারিদ্রসীমার ভেতরে ছিল না এমন ৭৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে গিয়েছেন। গত এপ্রিলে এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছিল পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্স সেন্টার এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
কষ্টের গল্প আছে অনেক
আব্দুর রহমান একটি ছোট কারখানা চালাতেন উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে। টিনের ছাদ দেওয়া একটি ভবনে তিনি টুপি তৈরি করতেন। প্রতি মাসে এই তিনি জায়গার ভাড়া দিতেন ২৫ হাজার টাকা। স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে যে ফ্ল্যাটে থাকতেন তার ভাড়া দিতেন ১৫ হাজার টাকা।
৭৫ জন কর্মী নিয়ে চলত তার কারখানাটি। মার্চের শেষের দিকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি কার্যকর হওয়ার পরই তার সকল কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যায়। তিনিও বাধ্য হন তার সব কর্মচারীদের চাকরীচ্যুত করতে।
অসহায় আব্দুর রহমান বলেন, ‘শুধু মেশিনগুলোর জন্যই প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শ্রমিকরা অপেক্ষার করছে তাদের বকেয়া বেতনের জন্য আর বাড়িওয়ালা বারবার চাচ্ছেন ভাড়া।’
সম্প্রতি তিনি তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে বরিশালের বাকেরগঞ্জে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি এখন তুরাগ এলাকার একটি ছোট ঘরে থাকেন। যেখানে মাসে ভাড়া দিতে হয় চার হাজার ২০০ টাকা।
তিনি বলেন, ‘আমিও আগামী মাসে ঢাকা ছাড়ব।’
অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। ফলে তাদেরও বাধ্য হতে হয়েছে শহর ছাড়তে।
সামাজিক সুরক্ষা বাড়াতে হবে
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্স সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্যই নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘মহামারির কারণে শহরাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বন্ধের সময় দারিদ্র্যে ডুবে থাকা নগরবাসীর কথা মাথায় রেখেই আরও আগে এই কর্মসূচি চালু করা উচিত ছিল।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, সরকারের উচিত ছিল মার্চ মাসে খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া। অনেক দেশ এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের সরকার এটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সরকারের উচিত নতুন দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া অবিলম্বে শুরু করা।’
ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িওয়ালারাও
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসায় আছে আফজাল হোসেন ও তার পরিবারের। তাদের ভাড়া দেওয়ার মতো ২০০টি আবাসিক ফ্লাটের মধ্যে গত এপ্রিল থেকে খালি রয়েছে ২৫টি।
আফজাল হোসেন বলেন, ‘আমরা রুমের ভাড়া সাত হাজার থেকে কমিয়ে পাঁচ হাজার এবং ফ্ল্যাটের ভাড়া ২৫ হাজার থেকে কমিয়ে ২০ হাজার টাকা করেছি। তারপরও ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না।’
তিনি আরও যোগ করেন যে তার পরিবার ঋণ নিয়ে ভবনগুলো তৈরি করেছে। সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে ঋণদাতারা।
তিনি বলেন, ‘এছাড়াও কয়েকজন ভাড়াটিয়া গত তিন মাস ধরে ভাড়া দিতে পারছেন না। অনেকে তাদের জিনিসপত্র রেখে গ্রামে চলে গেছে। আর ফিরে আসেনি।’
একই চিত্র রাজধানীর অদূরে সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে। এসব এলাকা স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের আবাসস্থল।
Comments