করোনাকালে যেমন আছে থাইল্যান্ডের অভিবাসীরা
একদিন রাতের খাবারের সময় থাই এক সহকর্মীর কাছ থেকে গল্পটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। থাইল্যান্ডের বহুল আলোচিত একটি সংস্কার বা কুসংস্কারও বলতে পারেন। থাইরা নাকি খাবার সময় মাছ উল্টায় না। মাছের এক পাশ খাওয়া শেষ করে কাঁটা ফেলবে, পরে না উল্টিয়ে মাছের অপর পাশ খাবে। এদের অনেকেই মনে করে আপনি যখন মাছ উল্টাচ্ছেন, ঠিক তখনই সমুদ্রে কোন তরী বা জাহাজ উল্টাবে। ঘটবে প্রাণের বিনাশ, সাথে সম্পদের ক্ষয় ক্ষতিতো আছেই। সুতরাং মাছ উল্টাতে গিয়ে জাহাজ উল্টানো যাবে না। বাধ্য হলাম থাই নিয়মে মাছ খেতে।
এই তরী ডুবির সাথে থাইল্যান্ডে অভিবাসী কর্মীদের একটি নিগূড় সম্পর্ক আছে। ১৯৮৯ সালের কথা। ওই বছর টাইফুন গে থাইলান্ডে আঘাত হানে, সাগরে ডুবে যায় দুই শতাধিক থাই মালিকানাধীন মাছ ধরার ট্রলার ও জাহাজ, মারা যায় কয়েকশ জেলে। নিখোঁজ হয় অনেকেই, যাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি। ওই সময় শুধুমাত্র থাই নাগরিকরাই মাছ ধরার কাজ করতো। অভিবাসী শ্রমিক তখন থাইল্যান্ডে খুব একটা ছিল না।
প্রাকৃতির দুর্যোগ গে থাইল্যান্ডে অভিবাসনের চিত্র যে পাল্টে দেবে সেটা অনেকেই ভাবেনি। যেমনটি ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে দেওয়ার অন্যতম নিয়ামক। ১৯৮৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় থাইল্যান্ডের জলসীমায় জেলেদের হতাহতের কারণ হয়, ঠিক ওই সময়েই থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন চলছিল। ১৯৯০ দশকের শুরুতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হু হু করে বাড়তে থাকে, বেকারত্ব কমে যায়। ফলে সাগরে কঠিন পরিবেশে মাছ ধরার কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করতে থাকে থাই নাগরিকেরা। আর এভাবেই সুযাগ তৈরি হয়ে যায় আশেপাশের দেশের নাগরিকদের থাইল্যান্ডে কাজ করার। থাই অভিবাসনে শুরু হয় নতুন মাত্রা।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক উত্থান থাইল্যান্ড এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মজুরির পার্থক্য ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এছাড়া কৃষি ও শিল্পকারখানা আধুনিকীকরণ, উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে, ফলে প্রতিবছর গড়ে প্রায় দশ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় থাইল্যান্ডে। এক দশকের মধ্যে থাইল্যান্ড একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং শ্রম অভিবাসনের জন্য মোট শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ, শ্রমিক গ্রহণকারী দেশে রূপান্তরিত হয়। থাইল্যান্ডে অর্ধ কোটির বেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করলেও এখন প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক থাই কর্মী কোরিয়া, জাপান, ইসরাইলসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ করতে যায়।
বর্তমানে থাইল্যান্ডে প্রায় ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখের বেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছে যাদের সিংহভাগই পাশের দেশ মিয়ানমার, লাওস, কম্পোডিয়া আর ভিয়েতনাম থেকে আসা। থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে খুবই কম সংখ্যক, মাত্র কয়েক হাজার।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই করোনার আঘাত থাইল্যান্ডে অভিবাসী শ্রমিকদের কঠিন অবস্থায় ফেলে দেয়। প্রথমে দিকে চীনের পর থাইল্যান্ডে বাড়তে থাকে করোনা রোগী শনাক্ত আর মৃতের সংখ্যা। মার্চের মাঝমাঝি সময়ে করোনার থাবা থাইল্যান্ডে ব্যাপক বিস্তার ঘটালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বিমান চলাচল সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি থাইল্যান্ডের ৭৭টি প্রদেশের মধ্যেও সীমানা বন্ধ হয়ে যায়, রাতে আরোপ করা হয় কারফিউ।
এর কয়েকদিনের মধ্যেই পাশের দেশেগুলোর সাথেও সীমানা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে বিপাকে পড়ে অভিবাসী শ্রমিকেরা। একদিকে কর্মহীন, অন্যদিকে দেশে ফেরার সুযোগ বন্ধ, দুইয়ে মিলে এক কঠিন সময় অতিক্রম করতে থাকে তারা। সঞ্চয়, ত্রাণ আর সামাজিক সংগঠনগুলোর সাহায্যে চলতে থাকে অস্বাভাবিক এক জীবন। রেমিটেন্স না পাঠাতে পারায় দেশে এদের পরিবার পরিজনও সঙ্কটে পড়ে যায়।
তবে মে মাসের মাঝামাঝি থাইল্যান্ডে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকলে ওই মাসের ২৫ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে সবকিছু খুলতে থাকে। আর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বলা যায় থাইল্যান্ডে সব কিছু খুলে যায় এবং একরকম স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়, যা নিউ নর্মাল নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু পর্যটক না আসার কারণে বিনোদনকেন্দ্রগুলো এখনও সেভাবে চালু হয়নি।
তবে চালু হওয়া সবগুলো প্রতিষ্ঠানে কঠোর নিয়মনীতি মানতে হচ্ছে। আপনি কোনো শপিংমলে বা অফিসে ঢুকতে চাইলে প্রথমে অ্যাপ দিয়ে চেক ইন করতে হবে, পরে থারমাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হবে। অ্যাপ না চালাতে পারলে নাম আর টেলিফোন নাম্বার লিখে ঢুকতে হবে। এরপর সব এন্ট্রি পয়েন্টে স্যানিটাইজার রাখা। যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে।
থাইল্যান্ডের জনগণ আইন মানার ব্যাপারে বেশ সজাগ। দোকান বন্ধ মানে বন্ধ, কোনও অবস্থায় খোলা পাবেন না। যদি বলা হয় রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া যাবে না। আপনি শত অনুরোধে দোকানের মালিককে রাজি করাতে পারবেন না। এর অর্থ সরকারি বিধিনিষেধ স্বপ্রণোদিতভাবে মেনে চলছে।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও জনগণ এখনও প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাচ্ছে না। অধিকাংশ অফিস কর্মীরা বাসা থেকে কাজ করছেন। একান্ত প্রয়োজন না হলে অফিসে যেতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে নির্মাণকাজসহ কৃষি, শিল্প কারখানা এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পুরো উদ্যমে কাজ চলছে। দেখলে মনে হবে না করোনা নামক আতঙ্ক তাদের কোণঠাসা করতে পেরেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৬ জুলাই পর্যন্ত থাইল্যান্ডে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩২৩২, মৃত্যু ৫৮ এবং সেরে ওঠা রোগীর সংখ্যা ৩০৯২ জন। গত দেড় মাসে থাইল্যান্ডে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। দু-চার জন রোগী পাওয়া যাচ্ছে যারা থাই নাগরিক, তবে দেশের বাইরে থেকে আসা। এরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে ফিরেছেন। বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারিন্টেনে থাকার সময় তাদের কেউ কেউ করোনা পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছেন এবং নির্ধারিত হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও থাই সরকার কোন রকমের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। এর ফলে বিমান যোগাযোগ এবং সীমানা খুলতে দেরি হচ্ছে। সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে পাশের দেশ থেকে শ্রমিকরা থাইল্যান্ডে আসতে পারছে না। দেশে কাজকর্ম না থাকায় এসব শ্রমিক থাইল্যান্ডে ফেরার জন্য মরিয়া। সম্প্রতি থাই সীমান্তে কয়েকশ কম্বোডিয়ান কর্মী আটক করা হয়েছে। এরা অনুমোদন ছাড়াই থাইল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করে।
বিদেশি শ্রমিক থাইল্যান্ডে করোনার বিস্তার নতুন করে ঘটাতে পারে এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে থাই সরকারের অর্জণ ব্যর্থ হতে পারে এমন আতঙ্ক কাজ করছে। এমতাবস্থায় খুব শিগগির থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিবেশি দেশগুলোর সীমানা খুলে দেওয়া হবে বা বিমানবন্দরগুলো পুরোদমে চালু হবে এমনটি এখনও আশা করা যাচ্ছে না। তবে থাইল্যান্ডে যেসব কর্মী আছেন তারা এখনও নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছেন এবং তাদের ভিসার মেয়াদ কোন ধরনের জরিমানা ছাড়াই বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন খুব বেশি দিন থাই সীমান্ত বন্ধ থাকলে পাশের দেশগুলো থেকে অভিবাসী কর্মীদের অনিয়মিত অনুপ্রবেশ ঠেকানো থাই সীমান্ত রক্ষীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
(লেখক: ব্যাংককে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত)
Comments