বন্যার পানিতে ডুবে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটে ২২ শিশুসহ ২৪ জনের প্রাণহানি

লালমনিরহাট সদরের মোগলহাট ইউনিয়নে ধরলা নদীর তীরবর্তী চর ফলিমারী গ্রামে ঝুঁকি নিয়ে বন্যার পানি অতিক্রম করে গন্তব্যে যাচ্ছে সাত বছর বয়সী এক শিশু। ২৪ জুলাই ২০২০। ছবি: স্টার

বন্যা পরিস্থিতি চলাকালীন কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় বন্যাদুর্গত এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে তাদের শিশুরা বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। গত এক মাসে কুড়িগ্রামে ১৬ শিশুসহ ১৮ জন ও লালমনিরহাটে ছয় শিশু বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান ও লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বিষয়টি দ্য  ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, আট বছরের কম বয়সী শিশুদের বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভেরখাস ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ গ্রামের বানভাসি আলমগীর হোসেনের স্ত্রী হাবিবা বেগম (২৮) জানান, গত ১৪ জুলাই দুপুরে তাদের দেড় বছরের মেয়ে লামিয়া আক্তার বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়। ‘আমি মেয়েকে আমাদের অস্থায়ী আশ্রয়ে উঁচু জায়গায় বসিয়ে রেখে বন্যার পানিতে কাপড় পরিষ্কার করছিলাম। আমার অজান্তে মেয়ে বন্যার পানিতে পড়ে পানিতে ডুবে যায়। কখন সে বন্যার পানিতে পড়েছিল, আমি বুঝতেই পারি নাই’, বলেন হাবিবা।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবাস গ্রামের বানভাসি আনিসুর রহমান (৩৫) জানান, গত ১০ জুলাই সকালে তার দুই বছরের ছেলে আরমান হোসেন বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে একা উঠানে খেলছিল। খেলার এক পর্যায়ে সে আমাদের অজান্তে বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে পড়ে যায়। তারপর পানিতে ডুবেই তার মৃত্যু হয়।’ 

‘যদি ছেলের প্রতি আমাদের নজরদারি থাকত, তাহলে ছেলেটা বন্যার পানিতে ডুবে মারা যেত না’, বলেন তিনি।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গাদ্দিমারী ইউনিয়নের গড্ডিমারী গ্রামের তিস্তাপাড়ের বানভাসি আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী মোমেনা বেগম (২৮) জানান, গত ১৩ জুলাই সকালে তাদের দুই বছরের মেয়ে আলিফা আক্তার বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি খাটের ওপরে বাচ্চাটিকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম এবং ততক্ষণে তিস্তা নদী থেকে বন্যার পানি আমাদের ঘরে প্রবেশ করেছিল। শিশুটি জেগে উঠে খেলতে খেলতে ঘরের ভেতর বন্যার পানিতে পড়ে যায়। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি আমাদের মেয়ে মরে পানির ওপর ভেসে আছে।’

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের বেলতলি গ্রামে দিনমজুর সুভাষ চন্দ্র রায় (৩৫) বলেন, ‘গত ২১ জুলাই সকালে আমার চার বছরের সন্তান চন্দ্রনাথ রায় বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়। বাড়ির উঠানে ছেলেটি একা খেলছিল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আমার স্ত্রী সুফলা রানী এখন পাগলপ্রায় প্রকৃতির হয়ে গেছে।’

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তাপাড়ের গড্ডিমারী গ্রামের বানভাসি কৃষক জহুর আলী (৫৮) বলেন, ‘বন্যার পানি বাড়িতে ঢুকলে আমরা বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি ঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই আমরা শিশুদের ওপর যথাযথ নজরদারি দিতেও পারি না। এ ছাড়াও, অনেক অভিভাবকও বন্যার পরিস্থিতি চলাকালীন তাদের শিশুদের রক্ষা করতে সচেতন নন।’

লালমনিরহাটে হাতীবান্ধা উপজেলার গাদ্দিমারী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান বলেন, ‘অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে তাদের শিশুরা বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় শিশুদের বন্যার পানি থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে কোনো প্রচার-প্রচারণাও নেই।’

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার থানাহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মিলন বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি চলাকালীন বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে শিশুদের বাঁচাতে মায়েদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা উচিত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি বানভাসি অভিভাবকদের মাঝে বন্যার পানি থেকে শিশুদের রক্ষা করতে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছি।’

কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কুড়িগ্রামের বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে বন্যার পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে বন্যার পানিতে শিশু ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর জন্য মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

‘অভিভাবকদেরও তাদের শিশুকে একা বন্যার পানিতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। একইসঙ্গে শিশুদেরকে সবসময় নজরে নজরে রাখতে হবে’, বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Magura child rape case trial begins; four indicted

The court has set April 27 for the next date of hearing in the case

32m ago