বিনোদন কেন্দ্র বাকল্যান্ড বাঁধ পরিণত হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্রে

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন কেন্দ্র বাকল্যান্ড বাঁধ পরিণত হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্রে। বাঁধের দুপাশের অধিকাংশ স্থানে গড়ে উঠেছে দোকান। বর্তমানে বাকল্যান্ড বাঁধের একমাত্র আহসান মঞ্জিলের সামনের অংশেই দুপাশ উন্মুক্ত আছে। এছাড়া বাঁধের কোথাও দুপাশে, আবার কোথাও একপাশে গড়ে উঠেছে দোকান ও সরকারি ভবন।
পার্কের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের মার্কেট। ছবি: রাশেদ সুমন

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন কেন্দ্র বাকল্যান্ড বাঁধ পরিণত হয়েছে ব্যবসা কেন্দ্রে। বাঁধের দুপাশের অধিকাংশ স্থানে গড়ে উঠেছে দোকান। বর্তমানে বাকল্যান্ড বাঁধের একমাত্র আহসান মঞ্জিলের সামনের অংশেই দুপাশ উন্মুক্ত আছে। এছাড়া বাঁধের কোথাও দুপাশে, আবার কোথাও একপাশে গড়ে উঠেছে দোকান ও সরকারি ভবন।

বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন উত্তর দিকে ‘করোনেশন পার্ক’ ও ‘লেডিস পার্ক’ নামের পার্ক দুটি বিলুপ্ত করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট। এর মধ্যে নারীদের জন্য তৈরি লেডিস পার্কের জায়গায় বর্তমানে রয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটি একতলা মার্কেট। আর করোনেশন পার্কের জায়গায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন বহুতল মার্কেট। এছাড়াও সদরঘাট ও ওয়াইজঘাট অঞ্চলে বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশের উন্মুক্ত স্থানে ঢাকা সিটি করপোরেশন গড়ে তুলেছে বেশ কিছু একতলা মার্কেট।

বর্তমানে বাকল্যান্ড বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে দুটি সংস্থা। এর মধ্যে বাঁধ, বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশের উন্মুক্ত স্থান ও পার্ক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং বাঁধ সংলগ্ন দক্ষিণের তীরভূমির দায়িত্বে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)।

বাঁধের দক্ষিণে নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা অংশে রয়েছে বিআইডাব্লিউটিএ নির্মিত ভবন, রয়েছে বেসরকারি দখলদাররও। জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বিআইডাব্লিউটিএ বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা জায়গায় পার্ক নির্মাণ, গাড়ি পার্কিংসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

তবে ঐতিহ্য গবেষক, স্থপতি ও নদী বিশেষজ্ঞরা বাঁধের দুপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও বাকল্যান্ড সংলগ্ন নদীতে অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থান খনন করে বাকল্যান্ড বাঁধকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গবেষকদের মতে, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাকল্যান্ড বাঁধের আগের সেই মনোরম পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

ব্রিটিশ আমলে বাদামতলী ঘাট থেকে ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকেই ঢাকার নাগরিকদের কাছে বৈকালিক ভ্রমণের জন্য বাঁধটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠে। অথচ এখন বাঁধের পূর্ব পাশে শাক-সবজি ও মসল্লা এবং পশ্চিম পাশে ফলের পাইকারি দোকান গড়ে উঠেছে। পচে যাওয়া কাঁচা পণ্যে সারা বছরই নোংরা হয়ে থাকে এককালের মনোরম এই বাঁধটি। আর দিনের অধিকাংশ সময় লেগে থাকে যানজট।

বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মিত হয়েছিল ঢাকার মধ্য দক্ষিণাঞ্চলে, দোলাই নদী এসে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হওয়ার দুটি মুখের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। ইসলামপুর ও ফরাসগঞ্জে দোলাই নদীর দুটি মুখ বুড়িগঙ্গায় মিলতো। ফরাসগঞ্জ থেকে লোহারপুল, গেণ্ডারিয়া, মুরগিটোলা, নারিন্দা, ধোলাইখাল, রায়সাহেব বাজার, তাঁতিবাজার হয়ে বাবুবাজার-ইসলামপুর পর্যন্ত ধোলাইয়ের প্রবাহপথ এবং ইসলামপুর, ওয়াইজঘাট, সদরঘাট, শ্যামবাজার ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার প্রবাহপথ মিলে তৈরি করেছে একটি প্রায় অর্ধ বৃত্তাকার ভূখণ্ড। এই অর্ধ বৃত্তাকার ভূখণ্ডের দক্ষিণে রয়েছে বাকল্যান্ড বাঁধ। ঢাকার অর্ধ বৃত্তাকার ভূখণ্ডের বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলটি ঢাকার ইতিহাসে বিগত পাঁচ শতাধিক বছর ধরে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

অবৈধ স্থাপনায় বাকল্যান্ড বাঁধ এখন আর বিনোদন কেন্দ্র নেই। ছবি: রাশেদ সুমন

সুলতানি আমলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক একটি মসজিদ সংস্কারের শিলালিপি পাওয়া যায় ইসলামপুরে। ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খানের প্রাসাদ ছিল ইসলামপুরে এবং তার নাম অনুসারে ইসলামপুর হয়েছে বলে জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মুঘল অভিযানের অন্যতম সামরিক কর্মকর্তা মির্জা নাথান রচিত ‘বাহরিস্থান-ই-গায়েবি’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ঢাকায় মুঘল রাজধানী হওয়ার পূর্বেই দোলাই নদীর সংযোগস্থলে ফরাসগঞ্জে ও ধোলাইয়ের অপর পাড়ে ছিল দুটি দুর্গ।

ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরের পর ইসলামপুর থেকে ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী মধ্য দক্ষিণাঞ্চল ইউরোপীয় কোম্পানি, বিশেষ করে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের অধিকারে চলে যায়। এর মধ্যে ইসলামপুর ও ফরাসগঞ্জে প্রতিষ্ঠা পায় ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি এবং সদরঘাট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি। কোম্পানি শাসনামলে অঞ্চলটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। মুঘল, নবাবি, এমনকি কোম্পানি আমলের প্রথমার্ধে ঢাকার প্রশাসন ও বিচারিক কর্মকাণ্ডের দপ্তর ছিল চকবাজার দুর্গে। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে কালেক্টরিয়েট, আদালতসহ সরকারি দপ্তরসমূহ স্থানান্তর করা হয় ওয়াইজঘাট ও সদরঘাট এলাকায়। সরকারি অফিস ছাড়াও সেখানে গড়ে উঠে ব্রিটিশ অভিজাতদের বাসভবন ও কারখানা। নদীতীরে নদীমুখী ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে ব্রিটিশরা গড়ে তোলে বিভিন্ন ভবন। কোম্পানি আমলেই বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী ফরাসি সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে যায়। হাত বদল হয় কয়েক দফা।  সেখানেও গড়ে উঠে প্রাসাদ। এর মধ্যে ইসলামপুরে আহসান মঞ্জিল এবং শ্যামবাজারে রূপলাল হাউজ অন্যতম।

কোম্পানি আমলে ঢাকার নান্দনিক ভবনসমূহ গড়ে উঠে মূলত ইসলামপুর থেকে ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার হয়ে আসেন সি.টি. বাকল্যান্ড। তার উদ্যোগে ইসলামপুর থেকে ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত নদীতীরে পাকা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে বাঁধ নির্মিত হয় নর্থব্রুক হল থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ-এর লেখা ‘ঢাকা ইতিহাস ও নগর জীবন ১৮৪০-১৯২১’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, তীরভূমিটি বা বাঁধটি ঢাকার একটি অলঙ্কার ও আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি একটি সুন্দর বেড়ানোর জায়গা হয়ে উঠে যেখান থেকে নদীর ব্যস্ত নৌ চলাচলের দৃশ্য উপভোগ করা যেত আর যার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঠাণ্ডা প্রকৃতি উপভোগ করা যেত। এরপর থেকে ঢাকার এক বিশাল জনগোষ্ঠী প্রতিদিন সকাল-বিকাল নির্মল বায়ু সেবনের জন্য এ বাঁধ দিয়ে হেঁটে বেড়াত।

বাঁধটি বাকল্যান্ডের অনুপ্রেরণায় নির্মিত হওয়ায় এটিকে বাকল্যান্ড বাঁধ নাম দেওয়া হয়। ১৮৭০-এর দশকে খাজা আবদুল গনি পশ্চিম দিকে ওয়াইজঘাট থেকে বাদামতলী ঘাট পর্যন্ত এবং ১৮৮০-এর দশকে রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস পূর্বদিকে নর্থব্রুক হল থেকে সবজিমহলে তাদের বাড়ির কাছ পর্যন্ত এই বাঁধের সম্প্রসারণ করেন। এভাবে বাঁধটি দৈর্ঘ্যে প্রায় এক মাইল বিস্তৃত হয়।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মনে করেন, ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদী তীরবর্তী একটি বাঁধ মুঘল আমল থেকে ছিল। বিভাগীয় কমিশনার সি টি বাকল্যান্ডের উদ্যোগে সেখানে পাকা বাঁধ নির্মিত হয়। তার লেখা ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘বাঁধ নির্মাণের সিংহভাগ ব্যয় বহন করেছিল ঢাকাবাসীরা এবং শুরু থেকে রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল পৌরসভার উপর।’

মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে, ঢাকার কালেক্টর ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বাকল্যান্ড বাঁধকে সরকারি সম্পত্তি বলে দাবি করলে তখন কালেক্টরের সঙ্গে ঢাকার পৌরসভার বিরোধ তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে ভোটাভুটিও হয় এবং কালেক্টরের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন পৌরসভার নির্বাচিত দেশি প্রতিনিধি ও সরকার মনোনীত শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকরাও।

মুনতাসীর মামুন তার গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেন, ‘ব্রিটিশ আমলে যা সম্ভব হয়নি, তা সম্ভব হয়েছিল আইয়ুব খানের আমলে। সরকার এক নির্দেশে ১৯৬৩ সালে বাকল্যান্ড বাঁধের সত্ত্বা জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দান করে দিয়েছিলেন অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআইডব্লিউটিএ-কে। যে রাস্তা বা বাঁধ এককালে ছিল ঢাকাবাসীর গর্ব ও আদরের বস্তু, যা ছিল সাধারণ মানুষের অবকাশ কাটানোর জায়গা, সেই বাকল্যান্ড বাঁধকে সরকারি প্রচেষ্টায় আমরা কদর্য স্থানে রূপান্তর করতে পেরেছি।’

বিগত শতাব্দীর আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে বাকল্যান্ড বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আবার ঢাকা করপোরেশনকে দেওয়া হয়। তবে হস্তান্তরের পর বাঁধের পরিবেশের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছিল। তখন শুরু হয় বাঁধের জায়গায় মার্কেট নির্মাণের প্রবণতা। আবুল হাসনাত মেয়র থাকাকালীন সময়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সদরঘাট ও ওয়াইজঘাটে বাঁধের উত্তর পাশে নির্মাণ করা হয় একতলা কয়েকটি মার্কেট। তখন স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ হওয়ার পর আর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব উদ্যোগে বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশে উন্মুক্ত স্থানে মার্কেট নির্মাণ হয়নি। এরপর বেসরকারি উদ্যোগে শুরু হয় সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে থাকা বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশে উন্মুক্ত স্থানে মার্কেট নির্মাণ।

সরেজমিনে দেখা যায়, অবৈধ দখলের ক্ষেত্রে বাঁধের অবস্থা সবচেয়ে অবনতি হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে থাকা উত্তর দিকের অংশ। বাদামতলী থেকে ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে সারি সারি দোকান। দোকানগুলো মূলত আড়ৎ। বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশে নির্মিত ভবনের অধিকাংশই একতলা। তবে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত আট থেকে দশটি বহুতল ভবনও রয়েছে।

বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সদরঘাট পর্যন্ত সড়কের বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন পূর্ব দিকে ছিল করোনেশন পার্ক এবং পশ্চিম দিকে ছিল লেডিস পার্ক। সদরঘাট থেকে লালকুঠি ঘাট পর্যন্ত ছিল করোনেশন পার্ক। তবে আকৃতিতে লেডিস পার্কটি ছোট ছিল বলে মুনতাসীর মামুন তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন। ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আরও উল্লেখ করেন, ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে করোনেশন পার্কটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

করোনেশন পার্ক ও লেডিস পার্ক প্রসঙ্গে ঢাকা গবেষক ও পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাশেম সূফী বলেন, ‘কালেক্টর ভবন এবং বাঁধের মাঝে ছিল করোনেশন পার্ক। করোনেশন পার্কের পশ্চিমে ছিল লেডিস পার্ক। ব্রিটিশ আমলে ঢাকার বড় বড় জনসভা অনুষ্ঠিত হত মূলত করোনেশন পার্কে। নেতাজী সুভাষ বসুসহ সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেছেন এই পার্কে। করোনেশন পার্কের মাঝে ছিল নবযুগ শরীরচর্চা কেন্দ্র নামে ব্যায়ামাগার। এটি পুরান ঢাকার শরীরচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল।’

বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হাশেম সূফী স্মৃতিচারণ করেন, ‘শৈশবে এক শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল লেডিস পার্কে। লেডিস পার্কটির অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধের পরেও ছিল।’

সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকা পার্ক দুটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। পার্ক দুটির স্থলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবন। মেয়র সাদেক হোসেন খোকার আমলে স্থানীয়দের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে করোনেশন পার্কের সর্বশেষ দখলমুক্ত অংশ নবযুগ শরীরচর্চা কেন্দ্র উচ্ছেদ করে নির্মাণ করা হয় বহুতল ভবন।

আহসান মঞ্জিল, রূপলাল হাউজ, নীলকর ওয়াইজের বাড়ি (বর্তমানে বাফা ভবন), লালকুঠি, কালেক্টরিয়েট ইত্যাদি ভবন এবং বাকল্যান্ড বাঁধের মধ্যবর্তী অংশ ছিল উন্মুক্ত। ফলে বাকল্যান্ড বাঁধ ও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে দেখা যেত ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত প্রাসাদোপম এসব ভবন। বাকল্যান্ড বাঁধের উত্তর অংশে দোকান নির্মাণ করায় আহসান মঞ্জিল ছাড়া অন্য সকল ভবন দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। বাঁধ বা নদী থেকে এখন আর সেগুলো দেখা যায় না।

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য অনুষদের ডীন ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাকল্যান্ডের অবদান হচ্ছে ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে নদী তীরবর্তী করে রাখা, শহরের দক্ষিণ সীমাকে অক্ষুণ্ণ রাখা। বাকল্যান্ড বাঁধের পশ্চিমে চকবাজার-লালবাগ অঞ্চলের ছোট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগ দুর্গ ইত্যাদি স্থাপত্যও নির্মিত হয়েছিল নদী তীরে। কিন্তু লালবাগ দুর্গ, বড় কাটরা, ছোট কাটরা ইত্যাদি স্থাপত্য থেকে নদী এখন বেশ দূরে সরে গেছে। আর বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর সীমানা গত দেড়শ বছরে পরিবর্তন হয়নি। বাকল্যান্ড বাঁধের দুপাশ থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলে এখনো বাঁধ ও নদী থেকে মানুষ দেখতে পাবে আহসান মঞ্জিল, রূপলাল হাউজ, ওয়াইজের বাসভবন, লালকুঠি, কালেক্টরিয়েট ইত্যাদি ঐতিহাসিক ভবন।’

বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশে মার্কেট নির্মাণ প্রসঙ্গে বিআইডাব্লিউটিএ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঢাকার সার্কুলার ওয়াটারওয়ে প্রকল্পের উপ প্রধান পরিচালক মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘প্রচলিত আইন অনুযায়ী নদী এলাকায় তীরভূমি থেকে ১৫০ ফুট উপর পর্যন্ত কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে বিআইডাব্লিউটিএর কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বাকল্যান্ড বাঁধ বা সংলগ্ন স্থানে মার্কেট নির্মাণের ক্ষেত্রে বিআইডাব্লিউটিএ কাউকে অনুমোদন দেয়নি।’

বিআইডাব্লিউটিএর তত্ত্বাবধানে থাকা বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন দক্ষিণে নদী ভরাট করে বেসরকারি দখলদাররা গড়ে তুলেছে দোকান। ২০০৪-০৫ সালে বিআইডাব্লিউটিএ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে। উচ্ছেদের পর পরিবেশবাদীরা অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থান খনন করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিআইডাব্লিউটিএ ভরাটকৃত মাটি খনন না করে নিজেরাই সেখানে অস্থায়ী মার্কেট নির্মাণ করে ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দেয়। তবে নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত জায়গায় নির্মিত বিআইডাব্লিউটিএর মার্কেটগুলো ২০১০ সালের পর ভেঙ্গে ফেলা হয়।

মার্কেটগুলো ভেঙ্গে ফেলা হলেও দখলদাররা এখনো সেখানে অস্থায়ী কাঠামোর দোকান তৈরি করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাদামতলীতে নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থানে রয়েছে সারিবদ্ধ দোকান। বাদামতলীতে দোকানগুলো মূলত ফলের আড়ৎ।

বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা অংশে সারিবদ্ধভাবে দোকান বানিয়ে ব্যবসা করা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলে মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা উচ্ছেদ করি। আবার তারা বসে যায়। তারা প্রভাবশালী।’

ওয়াইজঘাটে নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত একটি অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রাক ও মিনিবাস স্ট্যান্ড হিসেবে। রয়েছে রিকশার গ্যারেজও। দোকান, যানবাহন রাখার স্থান ছাড়াও বাকল্যান্ড বাঁধ সংলগ্ন দক্ষিণে নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত অংশে বাদামতলী, সদরঘাট, ওয়াইজঘাট ও শ্যামবাজারে রয়েছে চারটি মসজিদ।

বিআইডাব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বাঁধের পূর্বাংশ অর্থাৎ সদরঘাট থেকে ফরাসগঞ্জ পর্যন্ত বিআইডাব্লিউটিএর কাছে হস্তান্তর করেছিল। বিআইডাব্লিউটিএ ২০১৭ সালে সদরঘাট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর ভরাট করা অংশে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে। এর মধ্যে সদরঘাটে চারতলা একটি ভবন নির্মাণ অন্যতম। নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা অংশ তারা খনন করেনি। নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা অংশে ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।

অবৈধভাবে নদীর ভরাট করা অংশ খনন না করে সেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করি, কিছুদিন পর তারা আবার বসে যায়। এতে অপচয় হয়। সরকারি উদ্যোগে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করা হলে তারা আর বসতে পারবে না। অপচয় বন্ধ হবে।’

তবে নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা অংশ কেন পুনরায় খনন করা হচ্ছে না সে প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি দেননি।

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বাকল্যান্ড বাঁধ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শহরের মধ্যে নদী ও খালের তীরে নাগরিকদের চলাচলের জন্য প্রশস্ত ওয়াকওয়ে তৈরি করা আছে। নাগরিকরা সেখানে বৈকালিক ভ্রমণে বের হন। ঢাকায়ও একই উদ্দেশে বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। নদী ভরাট করে সরকারি ভবন নির্মাণ করার জন্য নয়।’

এশিয় স্থপতিদের সংগঠন আর্ক এশিয়ার নবনির্বাচিত সভাপতি ও বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাঁধের দুপাশের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করলে বাকল্যান্ড বাঁধে নাগরিকদের অবাধ চলাচলের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হতে পারে। বাকল্যান্ড বাঁধের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে আগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার দরকার সরকারি সংস্থাসমূহের। অবৈধভাবে ভরাট করা জায়গায় সরকারিভাবে ভবন নির্মাণ করলেই তো বৈধ হয় না। বিআইডাব্লিউটিএ সম্প্রতি নদীর অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থানে চারতলা বিশিষ্ট টার্মিনাল করেছে। স্থায়ী কাঠামোর দরকারই ছিল না। ফ্লোটিং টার্মিনাল, অস্থায়ী কাঠামোর টার্মিনালসহ বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বর্তমানে সুলভ। নদীর অবৈধভাবে ভরাট করা জায়গা খনন করে নদীকে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বাকল্যান্ড বাঁধ থেকে লঞ্চঘাটটিও সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।’

গবেষক হাশেম সূফী বলেন, ‘লন্ডনের টেমস নদীর তীরে স্থাপন করা বেঞ্চ ও বেঞ্চের ডিজাইন এবং শৈশবে দেখা বাকল্যান্ড বাঁধের বেঞ্চ ও বেঞ্চের ডিজাইন ছিল একই রকম। বাঁধের দুপাশ থেকে সমস্ত মার্কেট ও ভবন উচ্ছেদ করে আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হোক। বাঁধে আবার স্থাপন করা হোক বেঞ্চ। ঢাকার নাগরিকরা যাতে নদীতীরে হাটতে পারে, বসতে পারে।’

ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার যদি বিশ্ব ব্যাংকের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারে, তাহলে বুড়িগঙ্গা রক্ষা করাও সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা রক্ষা করা মানে শুধু নদীর প্রবাহ বা পানির পরিচ্ছন্নতা রক্ষা নয়, নদীর তীরও রক্ষা করা। বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে হলে সামগ্রিকভাবে রক্ষা করতে হবে। বুড়িগঙ্গার তীরে বাকল্যান্ড বাঁধ রক্ষা করতে হবে।’

অবৈধভাবে ভরাটকৃত স্থানে পার্ক, গাড়ি পার্কিংসহ কোনো স্থাপনা না করে বরং বাঁধের আদিরূপ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন উল্লেখ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘নৌ পরিবহণ মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর প্রতি আমার আস্থা আছে। সে এ বিষয়ে আন্তরিক। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপসের প্রতিও আস্থা আছে। তার পক্ষে এটা সম্ভব। তাপস যদি বাকল্যান্ড বাঁধকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে, তবে মানুষ চিরদিন তাকে মনে রাখবে।’

এ ব্যাপারে ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তরুণ সরকার একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

10m ago