পুলিশের গুলিতে সাবেক মেজর নিহতের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম শুরু

কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।
সিনহা মো. রাশেদ খান। ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আজ সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পৌঁছে কমিটির অপর তিন সদস্যকে নিয়ে বৈঠক করেন কক্সবাজার সার্কিট হাউসে।

কমিটির অপর তিন সদস্য হচ্ছেন- সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডারের মনোনিত প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) মনোনিত প্রতিনিধি অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান ও কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ শাহাজান আলী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ কর্তৃক গঠিত এই কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন কমিটির সদস্য মোহাম্মদ শাহাজান আলী।

আজ বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সার্কিট হাউসে তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আজ তদন্ত কমিটির বৈঠক করেছি। বৈঠকে কমিটির কর্মপদ্ধতি ও কাজের ধরণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিটি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত কর্মপরিধি মতে বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে। তদন্তের স্বার্থে যেখানে যাওয়া প্রয়োজন সেখানে কমিটির সকল সদস্য যাবে, যার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন কথা বলবে।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার বিকাল থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের সকল তল্লাশি চৌকির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকির কার্যক্রম যথারীতি চলছে।

টেকনাফের শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল মনজুর বলেন, ‘আজ সকালে কক্সবাজার আসার পথে মেরিন ড্রাইভ সড়কে শামলাপুর, ইনানী, উখিয়ার সোনারপাড়া ও হিমছড়ি পুলিশের তল্লাশি চৌকিগুলোতে পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখিনি।’

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় যে স্থানে পুলিশের পরিদর্শক ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীর গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হন সেটি কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে।

স্বাভাবিক নিয়মে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজার জেলা শহরে পৌঁছাতে ব্যক্তিগত গাড়িতে শামলাপুর থেকে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখে জানা গেছে ঘটনার দিন অর্থাৎ ৩১ জুলাই রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে নিহত সেনা কর্মকর্তার মরদেহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে পুলিশ।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন আজ বিকাল ৩টায় মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র পাঠিয়েছেন। সেখানে ঘটনার সময় আনুমানিক রাত ৯টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় টেকনাফ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন উপপরিদর্শক নন্দলাল রক্ষিত। এ মামলায় একমাত্র অভিযুক্ত আসামী করা হয়েছে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের সঙ্গে থাকা শাহেদুল ইসলাম সিফাতকে।

অপর একটি মামলা করা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। ওই মামলায় বলা হয়েছে সিফাতদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৫০টি ইয়াবা ও ২৫০ গ্রাম গাজা।

কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মারশবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা কমিউনিটি পুলিশের সদস্য নুরুল আমিনের (২১) বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শন করে গতকাল সোমবার বিকাল চারটায় দেখা যায়, বাড়িটি তালাবদ্ধ। প্রতিবেশীরা জানান, রোববার থেকে নুরুল আমিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু কোথায় গেছেন তারা জানেন না।

টেকনাফ থানায় যে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে, সেখানে বাদী উল্লেখ করেন, ‘নূরুল আমিন মুঠোফোনে রাত সাড়ে ৮টায় পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে জানান, মাথা ভাঙ্গা মারিশবনিয়া এলাকার গভীর পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত একজনসহ দুই জন টর্চ লাইটের আলো জ্বালিয়ে নেমে আসছে। মারশবনিয়া নতুন মসজিদের মাইকেও এই ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দুজন পাহাড় থেকে নেমে ব্যক্তিগত গাড়িযোগে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের দিকে চলে যাচ্ছেন। নুরুল আমিন এ কথা গ্রামের মানুষদেরও জানান।’

‘নুরুল আমিনের কাছ থেকে খবর পেয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলী পুলিশ ফাঁড়ি থেকে শামলাপুর পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে আসেন। এ সময় সিনহাদের গাড়িটিকে থামার সংকেত দিলে তারা তা না মেনে চলে আসার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে সড়কে ব্লক দিয়ে সিনহাদের গাড়ি থামান লিয়াকত আলী। এ সময়ে গাড়িতে থাকা দুজনকে বের হয়ে আসার জন্য বলেন। তখন নিজেকে মেজর পরিচয় দেন সিনহা। এরপর গাড়ি থেকে নামেন সিনহার পাশের আসনে বসা সঙ্গী সিফাত।’

‘এক পর্যায়ে লিয়াকত গাড়ির চালকের আসনে বসা সিনহাকে হাত মাথার উপর উঁচু করে দাঁড়াতে বলেন এবং তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চান। দুজন কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করতে উদ্যত হন। এ সময় আইসি স্যার (লিয়াকত আলী) নিজের ও সঙ্গী অফিসার ও ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে চারটি গুলি করেন।’

শামলাপুরের ঘটনাস্থল ও তার আশেপাশের এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ঘটনার পর এলাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে এক রকম চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।

বেশ কয়েকজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করার মাত্র  ১৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে আসেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার মরদেহের বিভিন্ন অংশ নিজের হাতে স্পর্শ করে দেখেন। এক পর্যায়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে সবাইকে মরদেহ দেখার জন্য বলেন।

ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১০ গজ দূরে বায়তুন নুর জামে মসজিদ। এই মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ আমিন। তিনি ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ঈদের দিন ঘটনাস্থলে তদন্তে যাওয়া সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের কাছে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, আর্মির পোশাক পরিহিত ব্যক্তি হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমেছেন। তিনি কোমরে হাত দেওয়ারও সুযোগ পাননি। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাকে সরাসরি গুলি করে। এ দৃশ্য দেখে ভয় ও আতংকে তিনি ঘটনাস্থল থেকে সরে যান।

ঈদের দিন সন্ধ্যা থেকে কোথাও এই মুয়াজ্জিনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার অবস্থান এখন কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। গুলি করার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর একটি মিনি ট্রাকে করে সাবেক মেজর সিনহার মরদেহ নিয়ে আসা হয় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।

মরদেহ ময়নাতদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক চিকিৎসক বলেন, ‘সিনহার শরীরের পিঠে, তলদেশে ও বুকে আঘাতের জখম ছিল। গুলির চিহ্ন ছিল বুকে, পিঠে ও তলদেশে।’

গতকাল সেনাবাহিনীর একটি দল টেকনাফ থানায় গিয়ে এই ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার কপি সংগ্রহ করে বলে জানা গেছে।

Comments