পুলিশের ‘বোমা নাটক’ থেকে দুর্ঘটনা

রাজধানীর পল্লবী থানায় বিস্ফোরিত বোমাটি থানার ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্যই। উদ্দেশ্য ছিল— বোমা উদ্ধারের নাটক মঞ্চস্থ করা এবং কাউকে সেই নাটকে ফাঁসানো। এমনটিই জানা গেছে বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সূত্র থেকে।

রাজধানীর পল্লবী থানায় বিস্ফোরিত বোমাটি থানার ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্যই। উদ্দেশ্য ছিল— বোমা উদ্ধারের নাটক মঞ্চস্থ করা এবং কাউকে সেই নাটকে ফাঁসানো। এমনটিই জানা গেছে বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সূত্র থেকে।

অদক্ষ হাতে এসব বোমা সামলাতে গিয়ে বোমাটি একজন অফিসারের কক্ষে বিস্ফোরিত হয়। এতে করে গত ২৯ জুলাই থানার ভেতরে চার পুলিশ সদস্য ও এক বেসামরিক ব্যক্তি আহত হন।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, অসাধু পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে ওজন মাপার মেশিনের ভেতরে লাগানো বোমাটি ‘সংগ্রহ’ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য নেতাদের ফাঁসিয়ে দেওয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা জানান, মঞ্চস্থ ‘বোমা উদ্ধার’ নাটকটি করার জন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছিলেন।

বিস্ফোরণের ঘটনাটি তদন্তের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) মনির হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।

তদন্ত করে কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে পল্লবী থানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাই শুধুমাত্র এই ঘটনার জন্য দায়বদ্ধ।

সপ্তাহব্যাপী তদন্ত শেষে কর্মকর্তারা জানান, বোমাটি থানার ভেতরে নেওয়ার কথা ছিল না এবং তারা বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটকেও বিষয়টি সময় মতো জানায়নি।

তদন্তকারীরা আরও জানান, পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার এই পরিস্থিতিতে যথাযথ নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনির দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ডিএমপি কমিশনারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বোমাটি থানায় সঠিক পদ্ধতিতে রাখা হয়নি এবং তারা অপেশাদারি কায়দায় কাজটি করেছে।’

এ ঘটনার পর ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ, অতিরিক্ত উপকমিশনার (পল্লবী) মিজানুর রহমান, সহকারী কমিশনার (পল্লবী) ফিরোজ কাওসার, পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মাবুদ ও পরিদর্শক (অপারেশন) এমরানুল ইসলামকে বদলি করা হয়েছে। যদিও ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এই বদলি শাস্তিমূলক নয়।

তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনটি আমার ভালোভাবে পড়তে হবে। এ ঘটনায় যে বা যারাই দায়বদ্ধ, তাদের জন্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে।’

বোমার উত্স

তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা জামিল ও মামুন নামে দুই ভাইকে সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত করেছেন। তারা ভারত ও নেপালের কোনো এলাকায় লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তদন্তের সঙ্গে জড়িত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই দুই ভাই পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানা কিংবা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম বাপ্পিকে হত্যা করার চুক্তি নিয়েছিলেন।’

পুলিশ তদন্ত শুরু করে গত ২৮ ও ২৯ জুলাই শহিদুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন ও রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা সন্দেহভাজন জামিলের সহযোগী বলে সূত্র জানিয়েছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই তিন জনকে গ্রেপ্তারের পর কাউন্সিলর বাপ্পি মিরপুর বিভাগীয় পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রায় দুই কোটি টাকার বিনিময়ে একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃতদের জুয়েল রানার গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘বাপ্পি ও জুয়েল রানা দুই জনই ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।’

পুলিশের সূত্র মতে, কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে জুয়েল রানাকে হারাতে চেয়েছিলেন বাপ্পি। পাশাপাশি বাপ্পি চান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে এবং পল্লবী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে। এজন্যই জুয়েলকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন বাপ্পি।

চুক্তি অনুসারে, পুলিশের একটি দল কালশী কবরস্থান এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের ধরে বাপ্পির কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেছিল। পুলিশ তার সহযোগীদের কাছ থেকে বোমা ও কয়েকটি গুলিও সংগ্রহ করেছিল।

কর্মকর্তারা এসব বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় নিয়ে যান। তদন্তের সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা জানান, বোমাটি যখন এক কর্মকর্তার কক্ষে নামিয়ে রাখছিলেন, তখন এটি বিস্ফোরিত হয়।

ডিএমপির উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মিরপুর বিভাগের ছয় জন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিভিন্ন তথ্য ও চুক্তি সম্পর্কে জানতে পেরে।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বিশেষ অ্যাকশন গ্রুপ (এসএজি) বিস্ফোরণের পর দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত করছে।

এসএজির উপকমিশনার আব্দুল মান্নান গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বেশ কিছু বিষয় সামনে এসেছে এবং তারা অনেকের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন।

তবে, তদন্তের স্বার্থে তিনি বিস্তারিত প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এখন তথ্য বিশ্লেষণ করছি।’

যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর বাপ্পি জানান, জুয়েলের সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক।

তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নই। কিছু মানুষ হয়তো আমার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি এবং জুয়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য গুজব ছড়াচ্ছে।’

বাপ্পি আরও জানান, তিনি জানতে পেরেছেন যে কেউ তাদের দুই জনকেই হত্যা করতে চেয়েছিল।

কে তাদের মরতে চেয়েছিল তা না জানিয়ে বাপ্পি বলেন, ‘পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে এবং আমরা সুষ্ঠু তদন্ত হবে বলে প্রত্যাশা করছি।’

দ্য ডেইলি স্টার জুয়েলের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তবে, তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago