‘অবহেলায় বেড়ে ওঠে তিস্তাপাড়ের শিশুরা’

লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তিস্তাপাড়ের কালমাটি এলাকার চার শিশু নদীর পাড়ে বসে গল্পে মগ্ন। ছবি: স্টার

চার শিশু মিলে খেলা করছিল তিস্তাপাড়ে। সাদেক ইসলাম (৪), মনিরুল ইসলাম (৪), শাহাদত আলী (৬) ও তুহিন ইসলাম (৬)। সারা শরীর ধুলো-মাটিতে ভরে গেছে। পেটে ক্ষুধা লেগে আছে। কিন্তু, তাদের গল্প বলা আর শোনার শেষ নেই। মাটির ওপর আরামে বসে একাগ্রচিত্তে তিস্তাপাড়ের নানা কথাই বলছে নিজেদের মধ্যে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তিস্তাপাড় কালমাটি এলাকায় এসব শিশুর সঙ্গে কথা হলে তারা চটপটে বলে দেয় তাদের দুরন্তপনার কথা। তিস্তাপাড়ে ছোটাছুটি করে সময় কাটে। কখন বেলা গড়িয়ে যায়, কোনো হদিস থাকে না। খাওয়া-নাওয়ার সময়ও ভুলে যায় তারা। আর পরিবারের লোকজনও তাদের খোঁজ রাখেন না।

‘মুই সকালে আলু ভর্তা দিয়া পান্তা ভাত খাইছোং’, চটপটে বলে দিলো তিস্তাপাড়ের শিশু সাদেক ইসলাম (৪)। ‘মোর মাও আর বাপ কাজ কইরবার গ্যাইছে। যখন বাড়িত আইসবে, মোক অ্যালা ডাকাইবে,’ সে জানায়।

মনিরুল ইসলাম (৪) বলে, ‘মুইও পন্তা ভাত খাইছোং। ডাইল দিয়া মাখি খাইছোং। আব্বা খেতোত গ্যাইছে। মাও বাড়িত আছে। দুপরা যখন ডাইকবে, মুই তখন বাড়িত যাইম।’

শাহাদ আলী ও তুহিন ইসলাম দুই জনেই স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু, পড়াশোনায় কোনো মনোযোগ নেই। বাড়ি থেকেও পড়াশোনার জন্য চাপ দেয় না। মাঝেমধ্যে গরু-ছাগল নিয়ে চরে যাওয়া লাগে ঘাস খাওয়ানোর জন্য।

তিস্তাপাড়ের শিশু শাহাদত ইসলাম (৬) বলে, ‘স্কুল বন্ধ। আর বাড়িতে কোনো পড়াশোনা হয় না।’ বাড়িত কে পড়াবে, এমন প্রশ্ন তুলে সে জানায়, প্রাইভেট মাস্টার নাই, কলম-খাতা নাই। ‘আব্বা-আম্মা কাইও পইড়বার কয় না। মাঝে মাঝে কয় গরু-ছাগল নিয়া চরোত যা। মুই নদীর বগলোত আসিয়া গরু-ছাগল ছাড়ি দিয়া সবার সঙ্গে খেলাধুলা করোং। ভালোই লাগে’, সে জানায়।

অপর শিশু তুহিন ইসলামকে তার জেলা, উপজেলার নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় দিবসগুলো সম্পর্কেও সে জানে না। তবে, ভালোভাবে বলতে পারে তিস্তাপাড়ের চরগুলোর নাম। কোন চরে ঘাস পাওয়া যায়, সেই খবরও সে জানে।

‘মুইতো পইড়বার চাং। কিন্তু, কাই মোক খরচা দিবে। স্কুলোত ভর্তি করি দিছে। কিন্তু, আর কোনো খবর নাই। মোরে না দ্যায় মাস্টার, না দ্যায় খাতা-কলম। মুই ক্যাং করি পড়াশোনা করিম,’ জানাল এই শিশু।

তিস্তাপাড়ের শিশু তুহিনের বাবা কৃষিশ্রমিক মেছের আলী (৪৫) বলেন, ‘হামরা তিস্তাপারোত জন্মিছি তিস্তাপারোত থাইকমো। হামার আর পড়াশোনা কিসোদ নাগে। হামরা পড়াশোনা করির পাং নাই, হামার ছওয়াও করবার নয়। হামরা য্যাদোন গায়ে-গর্দে থাঁটি-থুঁটি বড় হইছোং, হামরাও ছওয়াও ত্যামন করি হইবে।’

চরাঞ্চলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি এনজিও’র প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিস্তাপাড়ে প্রত্যেক পরিবারে শিশু রয়েছে। কিন্তু, অধিকাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। কিছু পরিবারের শিশু মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। কিছু পরিবারের শিশু প্রাথমিক বিদ্যারয়ে ভর্তি হলেও ঝড়ে পড়ে যায়। সর্বোচ্চ প্রাথমিকের গণ্ডি পার হলেও আর পড়াশোনা করে না।

‘অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে অবহেলায় বেড়ে ওঠে তিস্তাপাড়ের শিশুরা। স্কুলে পাঠানোর চেয়ে তাদেরকে কাজের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে অভিভাবকরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন’, এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তিস্তাপাড়ে অবিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে শিশুদের জন্য দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা হলে তারা স্কুলমুখী হয়ে মূলস্রোতে আসতে পারে।’

লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার গোলাম নবী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চরাঞ্চলের শিশুদের জন্য বিভিন্ন চলাঞ্চলে ১২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শুধু অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে তাদের শিশুদের স্কুলমুখী করছে না। শিক্ষকদের দিয়ে চরাঞ্চলে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সচেতনও করা হয়ে থাকে। চরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে সরকারিভাবে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হলে হয়তো শিশুদের স্কুলমুখী হওয়ার আগ্রহ বাড়ত, আর অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে বেশি আগ্রহী হতেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

45m ago