প্রশ্রয় ও শিথিলতায় শক্তিশালী স্বাস্থ্যখাতের সিন্ডিকেট

স্বাস্থ্যখাতের সিন্ডিকেটের একটি বড় নাম হিসেবে সামনে এসেছে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। অথচ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বছরখানেক আগেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে সুযোগ পেয়েছিল তা যথাযথভাবে নিলে এত দূর পর্যন্ত যেতে পারত না সে।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদুল্লাহর লেখা এক চিঠিতে বলা হয়, লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজ এবং মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি চিকিত্সা সরবরাহকারী সংস্থার মালিক মিঠু স্বাস্থ্যখাতের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে।

গত ৩০ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিটিতে বলা হয়েছে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কোনো চিকিত্সা সরঞ্জাম সরবরাহ না করেই প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে মিঠুর সিন্ডিকেট।

মানহীন পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্ক বিতর্কের কারণে মো. শহীদুল্লাহকে গত ২৩ মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সেনা সদর দপ্তরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। গত মাসে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

চিঠিতে তিনি এটাও বলেছিলেন যে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কেনাকাটাও নিয়ন্ত্রণ করে এই সিন্ডিকেট।

নোয়াখালী-৪ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী গত জুনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন মিঠুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

২০১৩ সালে স্বাস্থ্যখাতে বড় আকারের কিছু দুর্নীতি প্রকাশিত হওয়ার পর মিঠুকে তার সম্পদের বিবরণী জমা দিতে বলে দুদক। তাদের কাছে অভিযোগ ছিল, আয়ের উৎসের বাইরে তার রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ।

কিন্তু সে এই নোটিশের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেটের অনলাইন সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালের নভেম্বরে ছয় কোটি ছয় লাখ টাকা (আট লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার) দিয়ে নিউইয়র্কে একটি ভিলা কেনে মিঠু।

দুদক নোটিশ দেওয়ার পর তিন বছর অপেক্ষায় থেকে ২০১৬ সালের ১০ মে সম্পদের বিবরণী জমা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা করে।

তবে মামলাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি। কারণ, তৎকালীন কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে মামলাটি শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

যোগাযোগ করা হলে, মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদক সহকারী পরিচালক সিরাজুল হক গত ১৪ জুলাই জানান, কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে এবং এজন্যই কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে অভিযোগপত্রের পরিবর্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার।

ত্রুটিগুলো কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, নথি না দেখে তিনি তা বলতে পারবেন না। এ বিষয়ে জানতে পরে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি ওই সময় অভিযোগপত্র দাখিল করা হতো, তাহলে মিঠু এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারত না।’

দুদক আরেকটি সুযোগ পেয়েছিল

২০১৬ সালে দুদক যখন মামলা করে, তখন পানামা ও প্যারাডাইজ পেপার ফাঁসেও মিঠুর নাম জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়।

২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) প্রকাশিত প্রথম ফাঁস হওয়া তথ্যে ৩২ বাংলাদেশির নাম ছিল। ২০১৬ সালে এর দ্বিতীয় কিস্তিতে আইসিআইজে তিনটি নতুন প্রতিষ্ঠান, ১৪টি নতুন ঠিকানা এবং ২৪ জনের নাম প্রকাশ করে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আছে।

এ সময় বাংলাদেশের মিঠু, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম ও বেনজির আহমেদের সঙ্গে কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সন্দেহজনক লেনদেন দেখা যায়।

তাদের মধ্যে মোকসেদুল ইসলাম ব্লেয়ার এভিয়েশনের মালিক। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কালো তালিকাভুক্ত ১৪টি মেডিকেল সরবরাহকারীর মধ্যে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে সে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নিউইয়র্ক শহরের ডিরেক্টরিতে দেওয়া তথ্য অনুসারে, তার ও মিঠুর ঠিকানা একই।

বেনজির আহমেদ নিউইয়র্কে মিঠুর প্রতিবেশী। মিঠু যেদিন তার ভিলা কেনে, সেই একই দিনে বেনজির তার পাশের ভিলাটি কিনে মিঠুর প্রতিবেশী হয়। নিউইয়র্কের জমিজমা বিক্রির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এই ভিলাটি কিনেছে আট লাখ ৭৩ হাজার মার্কিন ডলারে।

এই ঘটনা ফাঁসের পর, উপপরিচালক এস এম আক্তার হামিদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে দুদক। এই কমিটির দায়িত্ব, এ ঘটনায় যাদের নাম প্রকাশ পেয়েছে তারা অর্থ পাচার করেছেন কিনা তা অনুসন্ধান করা।

গত ১৬ জুলাই আক্তার হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাদের লেনদেনের বিষয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়েছে দুদক। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো তথ্য পাইনি। আমাদের তদন্ত চলছে।’

দুদক যখন তথ্য পাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের সাম্রাজ্য প্রসারে সময় কাটাচ্ছে মিঠু।

ওপেনগোভনি ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মিঠু এম গেটওয়ে করপোরেশন নামে একটি মেডিকেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চালু করেছে। এই ওয়েবসাইটটি নিউইয়র্ক রাজ্য সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির প্রকাশিত ডেটা সবাইকে দেখার সুযোগ করে দেয়।

ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, মিঠু সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ১০ লাখ মার্কিন ডলার।

এম গেটওয়ে করপোরেশনের ফোনে মিঠুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দ্য ডেইলি স্টার। তবে এম গেটওয়ের নাম্বার হিসেবে দেখানো সেই নাম্বারটি তাদের ছিল না। এটি মিঠুর প্রতিবেশীর মালিকানাধীন প্রবাসী বাংলাদেশির প্রতিষ্ঠানের নাম্বার।

দুদকের মুখোমুখি হননি মিঠু

চলতি বছরের ১ জুলাই, দুদক মিঠুসহ পাঁচ জনকে এন-৯৫ মাস্ক এবং পিপিই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিল। ৯ জুলাইয়ের আগে তাকে কমিশনে হাজির হতে বলা হলেও মিঠু আসেনি।

দুদককে দেওয়া এক চিঠিতে সে জানায়, ২০১৫ সাল থেকে সে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এবং মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসে। ‘আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই।’

যোগাযোগ করা হলে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানান, মামলায় চার্জশিট না দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পিছনে কী কারণ ছিল, তা তিনি জানেন না।

পানামা পেপার ফাঁস তদন্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০১৫ সাল সংশোধিত অর্থ পাচার আইনটি এ বিষয়ে দুদকের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শুধুমাত্র সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলার তদন্ত করতে এবং মামলা করতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পানামা পেপার ফাঁসের বিষয়ে আর জিজ্ঞাসাবাদ করছি না। অন্যান্য সরকারি সংস্থা এটি করবে।’

মিঠুর সিন্ডিকেটের বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং সংসদ সদস্যের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দলিল ছাড়া কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি না। জনসাধারণ অনেক অভিযোগ তুলতেই পারেন। কিন্তু, প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে মামলা করে আমরা আদালতে সামনে হাসির পাত্র হতে চাই না।’

স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিঠুর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।’

বিভিন্ন মামলার নথি থেকে দেখা যায়, অর্থ পাচার আইনে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও মামলা করেছে দুদক।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের ১৩ মে দুবাইয়ে ১৮৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু এবং আরও তিন ব্যবসায়ীর নামে অর্থপাচার আইনে মামলা করেছে দুদক।

অর্থপাচার বিষয়ে দুদকের এখতিয়ারে দুটি হাইকোর্ট বেঞ্চের ব্যাখ্যার কথা উল্লেখ করে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম বলেন, ‘যদি এই পাচার দুর্নীতির পরিধিতে আসে তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ার রয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার। হাইকোর্ট বেঞ্চ দুটি অন্তত দুই বছর আগে এই পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত আপিল বিভাগ এই সিদ্ধান্তে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, দুদক যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, তাতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায় স্পষ্টতই তাদের নিজের উপর অনেকটা চাপিয়ে নিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে দুর্নীতি অব্যাহত থাকার অনেক কারণ রয়েছে। তবে এটাও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে দুদক যদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত রিংলিডারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে পারতো, তাহলে সাধারণ ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকত।’

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago