চকরিয়া

‘টাকা না দেওয়ায়’ প্রবাসী জাফরকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগ

‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত মো. জাফর। ছবি: সংগৃহীত

ওমান প্রবাসী এক বাংলাদেশির বড় ছেলে মো. জাফর। চট্টগ্রামের পটিয়ায় বসবাসকারী জাফর তার পরিবারের খরচ জোগাতে টেম্পু চালাতেন। দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে এমন লড়াইয়ে তিনি যখন ব্যস্ত, তখন তার সামনে সুযোগ আসে মধ্যপ্রাচ্যের এক আরব দেশে গিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার। সেই সুযোগ তিনি লুফে নেন। নয় বছরেরও বেশি সময় বিদেশে অমানবিক পরিশ্রম করে পরিবারকে এনে দেন সচ্ছলতা।

কিন্তু, জাফর জানতেন না যে ভবিষ্যতে তার ভাগ্যে কি রয়েছে।

ঈদুল আজহার আগের দিন, ৩১ জুলাই ২০২০, ভোরে কক্সবাজারের চকরিয়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ৩৭ বছর বয়সী জাফর। স্থানীয়রা জোর দিয়ে তাকে নির্দোষ দাবি করলেও পুলিশের ভাষ্য মতে তিনি ছিলেন ইয়াবা চোরাকারবারি।

একই দিনে, একই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার মো. হাসান (৩৭) এবং চকরিয়ার শান্তিনগর এলাকার জহির আহমেদ (৪৫) নামে আরও দুজন নিহত হন। সন্দেহ ও প্রশ্ন ওঠে এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।

গত ১২ মার্চ ছুটিতে দেশে ফিরেছিলেন জাফর। ‘বন্দুকযুদ্ধে’র পর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন যে তার পটিয়ার বাসভবন থেকে পুলিশ সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাছ থেকে ‘৫০ লাখ টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করে’।

গত রোববার জাফরের পরিবার চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এবং কক্সবাজারের হরবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক আমিনুল ইসলামকে হত্যার অভিযোগে পটিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলায় সাক্ষী হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারসহ নয় জনের।

আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টকে (সিআইডি) এই ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

জাফরের বাবা আবদুল আজিজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার ছেলে গত নয় বছর ওমানে ছিল। আমাদের সঙ্গে কদিন থাকতে প্রতিবছরই পটিয়ার কচুয়াই ইউনিয়নের বাড়িতে আসত। এবারও তার চলে যাওয়ার কথা ছিল আরও আগেই। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সে যেতে পারেনি।’

‘আমি নিজে ১৮ বছর ওমানে কাজ করে আমার পরিবারের ভাগ্য বদলাতে পারিনি। আমার ছেলেটা পেরেছিল। সে ভালো বেতনের চাকরি করত। তার পাঠানো টাকা দিয়েই আমরা আমাদের বাড়িসহ আরও অনেক সম্পত্তি কিনেছি।’

আজিজ জানান, গত ২৯ জুলাই ভোর ৬টার দিকে পুলিশের পোশাকধারী দুই জন এবং সাদা পোশাকের আরও বেশ কয়েকজন তাদের বাড়িতে উপস্থিত হন। এটা কথিত বন্দুকযুদ্ধের দুদিন আগের ঘটনা। জাফর দরজা খুলে দিলে তারা পটিয়া থানার সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন।

এরপর পুলিশ তার ছেলেকে নিয়ে কক্সবাজারের দিকে চলে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা আমার ছেলের হাতে হাতকড়া পড়ান। একপর্যায়ে তারা তার ঘরে তল্লাশি করেন এবং আলমারি থেকে দামি জিনিসপত্র সব নিয়ে যান।’

আজিজের অভিযোগ, পুলিশ পরে তাদের একাধিকবার ফোন করে এবং ছেলের মুক্তির জন্য ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারলে জাফরকে বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘৩১ জুলাই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার আনোয়ার হোসেন আমাদের ফোনে জানান, কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জাফর নিহত হয়েছে। তার মরদেহ কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা আছে।’

যোগাযোগ করা হলে, কচুয়াই ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পটিয়া পুলিশ আমাকে বন্দুকযুদ্ধের খবর জানিয়ে বলেছিল যে জাফরের পরিবারের যেন মর্গ থেকে তার মরদেহটি নিয়ে যায়।’

তিনি আরও জানান, মাত্র দেড় বছর আগে বিয়ে করেছিলেন জাফর। জাফর অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যতদূর আমি জানি, কোনো থানায় তার নামে কোনো প্রকার অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না।’

ভুল পরিচয়ের বলি হাসান?

৩১ জুলাইয়ের ঐ ‘বন্দুকযুদ্ধে’র শিকার হাসানকেও তার এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, তিনি পটিয়া পৌরসভার ছয় নম্বর ওয়ার্ডের পাইকপাড়া এলাকার একজন দরিদ্র রিকশাচালক ছিলেন।

ঐ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিউল আলম বলেন, ‘হাসান তার পরিবার চালাতে দিনরাত পরিশ্রম করত। আমি যতদূর জানি, তার কোনো ধরনের অপরাধের রেকর্ড ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পটিয়া পুলিশ আমাকে জানায় যে পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের ঘটনায় হাসান নিহত হয়েছে। পরে আমি তার পরিবারকে বিষয়টি জানাই।’

এই পৌরসভার ভেতরে আরও একজন হাসান আছেন, যিনি ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে পরিচিত জানিয়ে কাউন্সিলর বলেন, ‘এটা পরিচয়ের ভুলে হতে পারে।’

জাফর বা হাসানের নামে পটিয়া থানায় কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে থানার ওসি বোরহান উদ্দিন গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নথিপত্র যাচাই না করে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। পরে আপনাকে এটা জানাব।’

সেই ‘বন্দুকযুদ্ধ’

‘বন্দুকযুদ্ধে’র পর, চকরিয়া পুলিশ দাবি করে, ৩১ জুলাই ভোর একটার দিকে তারা ইয়াবাসহ দুজনকে আটক করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে জানায়, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বোয়ালতলী এলাকায় ইয়াবা বিতরণ করছে।

পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম জানান, এই তথ্যের ভিত্তিতে, ভোররাত আড়াইটার দিকে পুলিশ ওই এলাকায় অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে অপরাধীরা গুলি চালালে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা জবাব দিলে এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা ঘটে।

আমিনুল আরও জানান, ‘বন্দুকযুদ্ধে’র পর ঘটনাস্থল থেকে জাফর, হাসান ও জহিরের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে। তারা তিন জনই ইয়াবা চোরাকারবারি চক্রের সদস্য ছিল। এদের মধ্যে জহিরের নামে তিনটি মাদক মামলা রয়েছে।

পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪৪ হাজার ইয়াবা, দুটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং সাতটি কার্তুজ উদ্ধার করেছে বলেও দাবি করেছে।

তিনিসহ চার জন এ ঘটনায় আহত হয়েছেন বলে জানান এই পুলিশ পরিদর্শক। আহত বাকি তিন জন হলেন, চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান, কনস্টেবল সাজ্জাদ এবং কনস্টেবল সবুজ।

আমিনুল এ ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেন। মৃত তিন জনকে পুলিশের কাজে বাধা দান ও তাদের হত্যা চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

এ বিষয়ে মন্তব্যে নেওয়ার জন্য বারবার আমিনুল ও হাবিবুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা চেষ্টা করা হলেও তারা কোন উত্তর দেননি।

জাফরের বাবার ছেলে হত্যার বিচার পেতে তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক সেটাই তিনি চান।

শোকার্ত এই বাবা বারবার বলছিলেন, ‘আমার ছেলে নির্দোষ ছিল। কারো সঙ্গে তার শত্রুতা ছিল না। ওরা আমার ছেলেটাকে টাকার জন্য খুন করেছে। আমি ন্যায়বিচার চাই।’

Comments

The Daily Star  | English

Violence against women, children: Over 35,000 cases unresolved for over 5 years

More than nine years have passed since a case was filed over the rape of a nine-year-old schoolgirl in Dhaka’s Khilkhet area. The tribunal dealing with the case has framed charges against the lone accused and held 96 hearings but is yet to complete the trial.

11h ago