শুধু আমাকেই শুটিংয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়: সাইদা খানম
চলে গেলেন সাইদা খানম। তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি সর্বজনবিদিত। আলোকচিত্রী হিসেবে তার অর্জনের তালিকা অনেক বড়। বেগম পত্রিকায় পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করার আগে থেকেই ছবি তুলতেন তিনি।
মাদার তেরেসা, সত্যজিৎ রায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ, চাঁদে প্রথম পদার্পণকারী তিন নভোচারীসহ অনেক উল্লেখযোগ্য মানুষ তার ক্যামেরায় বন্দী হয়েছেন। দেশের জন্য সাইদা খানম বয়ে এনেছেন অনেক আন্তর্জাতিক পুরষ্কার। একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান, পাকিস্তান, ভারত, সাইপ্রাসসহ অনেক দেশে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন, একক প্রদর্শনী করেছেন।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে সাইদা খানম বলেছেন আলোকচিত্রী হিসেবে তার ভাবনা ও কিছু অভিজ্ঞতার কথা। তখন সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়নি। আজ যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তিনি নেই! এই সাক্ষাৎকারে শৈশবের স্মৃতিচারণ করেছিলেন আবেগঘন হয়ে।
ফটোগ্রাফার হিসেবে আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিলেন? কারো ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কি?
বিশেষভাবে কারও ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হইনি। দেশি বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া ছবিগুলো দেখতাম, মনে মনে ভাবতাম ছবিগুলো কীভাবে তোলা হলো। খেয়াল করতাম রোদ কখন থাকে, ছায়া কখন পড়ে। এখনকার দিনে ছবি তোলা তো অনেক সহজ হয়ে গেছে। তখনকার দিনে আমাদের সূর্যের কাছে প্রার্থনা করতে হতো (হাসি)। তবে, তার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। অনেক বড় বড় মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, তাদের ছবি তুলেছি।
বিখ্যাত মানুষদের ছবি তোলার ব্যাপারটা আপনার কেমন লাগে?
খুব ভালো লাগে। ছবি তোলা মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে খুব সাহায্য করে। এই যেমন তুমি এলে, ছবি তোলার ব্যাপারে একটু কথাবার্তা হলো। এভাবে মানুষের সঙ্গে তাড়াতাড়ি ক্লোজ হওয়া যায়।
এর মধ্যে আপনার কিছু ভালো লাগার অভিজ্ঞতা যদি বলেন।
ভালো লাগার মত অনেক ঘটনাই তো আছে। সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলেছি। মাদার তেরেসার ছবি তুলেছি। আরও অনেকের কথাই বলা যায়। একটা দুঃখজনক ঘটনাও ছিল। সেকথা এখন না বলি। ছবি তুলতে গেলে তো অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও যেতে হয়। তবে মোটামুটিভাবে বলতে গেলে, ছবি তুলতে গিয়ে সহযোগিতাই বেশি পেয়েছি।
সত্যজিৎ রায়ের ছবি তোলার অভিজ্ঞতাটি কেমন ছিল?
পারভেজ সাহেব তখন চিত্রালীর সম্পাদক ছিলেন। তাকে বললাম যে সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলতে চাই। তিনি আমাকে বললেন যে সত্যজিৎ রায় ভীষণ গম্ভীর মানুষ, কারো সঙ্গে কথা বলেন না। শুনে মনটা দমে গেল। কলকাতায় আমার বন্ধুরা শুনে বলল, তোমার তো অনেক সাহস! যা হোক, ভেবে-চিন্তে ফোন দিয়েই ফেললাম। দুদিন পরে বিকেলে সত্যজিৎ রায় সময় দিলেন। লেক টেম্পল রোডে তখন থাকতেন। সময়মতো গিয়ে দেখলাম ঘরের দরজাটা একটু খোলা, ড্রইংরুমে চেয়ার-টেবিলে বসে তিনি লিখছেন। আমি তখন ভাবছি, আমার বোধ হয় আসা ঠিক হয়নি। এত বড় মানুষটার সামনে কী করে দাঁড়াব! ঠিক তখনই সত্যজিৎ রায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’ এই ‘কে’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধড়াশ করে উঠল। বললাম, চিত্রালী থেকে এসেছি। তিনি আমাকে ভেতরে ডাকলেন। আমার দিকে তাকালেন। একটু পরে বললেন, ‘আমার সম্পর্কে আপনি কী জানতে চান?’ আরও নার্ভাস হয়ে গেলাম। তারপর বুদ্ধি করে তার সদ্য শুটিং করা ছবির সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তারপর সেখান থেকে কথা আগাতে থাকে। তার ছবির শুটিং-এ তিনি কোনো প্রেসকে যাওয়ার অনুমতি দিতেন না। আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। কত বড় সম্মান!
এখন কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন? লেখালেখি করছেন এখন?
লেখালেখি তো করিই। আমি সাধারণত ছোটগল্প লিখি। এটা ওটা নিয়ে লিখি। বেশি কঠিন বিষয় নিয়ে লিখি না।
এখন কি ছবি তোলেন?
ছবি তোলা তো একটা নেশা।
এখন কী ধরণের ছবি তোলেন?
এখন যা ভালো লাগে, তারই ছবি তুলি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য ভালো লাগলে ছবি তুলি। মানুষের ছবি তুলি। মানুষ কাজ করছে, নদী থেকে পানি তুলছে এসব দেখি, ছবি তুলি। ছবি তুলতে ভালো লাগে।
ছবি তোলার জন্য কোন ধরণের আলো আপনার পছন্দ?
এটা বলা কঠিন ব্যাপার। একটা ভালো সাবজেক্ট কখন পাব তা তো আসলে সবসময় আলোর উপরে নির্ভর করে না, সময়ের উপরে, ঘটনার উপরে– অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে। ভালো ছবি তোলার জন্য মানসিক একটা চিন্তাধারা থাকা দরকার। প্রকৃতির ছবি তোলার সময় রোদ কোথায় থাকবে, গাছের ছায়াটা কোথায় পড়বে, এগুলো চিন্তা করতে হয়। মানুষের ছবি তোলার সময় এতটা ভাবার সুযোগ থাকে না, পরিস্থিতি বুঝে তুলতে হয়।
রোলিকর্ড ক্যামেরাটা কি এখনো ব্যবহার করেন?
এখন ওটা আর ব্যবহার করা হয় না। ১২০ ফরম্যাটের ফিল্ম পাওয়া যায় না। এখন ৩৫ ফরম্যাটের ক্যামেরা ব্যবহার করি। ৩৫ ফরম্যাটের সুবিধা আছে, আকারে ছোট।
ছবি তুলতে গেলে কী কী বিষয় চিন্তা করেন?
সভা-সমিতির ছবি তুলতে গেলে একটু সচেতন থাকতে হয় যেন ধাক্কা-টাক্কা খেয়ে পড়ে না যাই। সবাই তো আসলে ভালো ছবি তুলতে চায়। তবে অন্য ফটোগ্রাফাররা আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেছে। পোট্রেট তোলাটা কিন্তু কঠিন। সবসময় ভালো পোট্রেট তোলা যায় না। মানুষের ব্যক্তিত্বটা ফুটিয়ে তুলতে হয়। শুধু চেহারাটা ফুটলেই হবে না, মানুষটাকে তোলা দরকার। সেটা সবসময় পাওয়া যায় না। আবার বিপ্লব, আন্দোলন এসবের ছবি তোলা কঠিন। এসব ছবি তুলেছি, তবে খুব বেশি তোলা হয়নি।
আপনি দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী। ওই সময় তো মেয়েদের জন্য ফটোগ্রাফার হওয়াটা বেশ কঠিন ছিল।
আসলে আমাদের বাড়িটা খুব প্রগতিশীল ছিল। মা, খালা, আপারা সবাই প্রগতিশীল ছিলেন। তা না হলে সম্ভব হতো না। আমার ছবি তোলার ঝোঁক দেখে মেজ আপা হামিদা খানম (হোম ইকনমিক্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল) রোলিকর্ড ক্যামেরাটা এনে দেন। তা না হলে ভালো ছবি তুলতে পারতাম না। দেশভাগ হওয়ার পরে বেগম পত্রিকা যখন ঢাকায় চলে এল, তখন কবিখালা (কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা) আমাকে সঙ্গে করে বেগমের অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। নাসিরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাসিরুদ্দিন সাহেব আমাকে বেগম পত্রিকার কাভার এবং ভেতরের জন্য ছবি তুলতে বললেন। তখন আমার মনে হলো যে আমি একটা জায়গা পেয়ে গেলাম। যে কাজটা আমি করছি সেটা প্রকাশ না হলে তো ভালো লাগে না। বেগম পত্রিকা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। নাসিরুদ্দিন সাহেব খুব ভালো মানুষ ছিলেন। মেয়েদের প্রগতি ও জাগরণের বিষয়ে চিন্তা করতেন। নুরজাহান আপা তার এই চিন্তাকে গ্রহণ করে পত্রিকা চালু করে ফেলেন। সমাজে এরকম মানুষ থাকা দরকার। সব পুরুষের মধ্যে এটা থাকে না। সবাই যে মেয়েদের খুব সহানুভূতির সঙ্গে দেখেন, তা আমার মনে হয় না। সত্যিকারের আদর্শবাদী মানুষেরা উপলব্ধি করেছেন যে মেয়েদের উন্নতি হওয়া দরকার। মেয়েরা তো মায়ের জাত। তাদের উন্নতি না হলে সন্তানেরাও সেভাবে শিক্ষিত হতে পারবে না।
অনেকের কথাই তো বললেন যাদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছেন। আপনার মায়ের কথা বলুন।
আমার মা সেকালের মানুষ হলেও খুব প্রগতিশীল ছিলেন। তার মধ্যে কোন সংস্কার ছিল না। সব ধর্মের, জাতির মানুষকে তিনি আপন করে নিতে পারতেন। তার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হতো। তাকে দেখতাম সংসারের কাজ শেষ করে খাওয়া দাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে বই পড়তে। দেশ বিদেশ ভ্রমণ করতে, মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করতেন। ধর্মীয় আচারগুলোও সুন্দরভাবে পালন করতেন। রোজার সময় আমিও মায়ের সঙ্গে শেষরাতে উঠে পড়তাম। আমাদের বাড়িতে একটা বড় নিমগাছ ছিল। তার তলায় চুলো করে কাজের মেয়েরা রুটি বানাত, খাওয়া দাওয়া হতো। আমরাও মায়েদের সঙ্গে ওখানে গিয়ে বসতাম। আমাদের ছয়টা বিলাতি কুকুর ছিল। তারা দূরে বসে থাকত রুটি খাওয়ার আশায়। মা খুব জীবজন্তু ভালোবাসতেন। কুকুর ছাড়াও হরিণ ছিল, ময়ূর ছিল, নয়টা বিড়াল ছিল। বিড়ালগুলো প্রাচীরের উপরে বসে থাকত। খাবার দিলে নেমে আসত। সবার মা-ই তো আসলে ভালো। তোমার মা তোমার কাছে ভালো, আমার মা আমার কাছে ভালো।
ছোটবেলার আর কী কথা আপনার মনে পড়ে?
ছোটবেলায় আমি একটু দুর্বল ছিলাম, শরীরটা খুব ভালো ছিল না। এজন্য আমাকে পড়াশোনার ব্যাপারে খুব চাপ দেওয়া হতো না। মুক্তমনে ঘুরে বেড়াতাম। আপারা স্কুলে চলে গেলে আমিও বাড়ি থেকে বের হতাম। পাড়ার সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে কাচারিতে ঘুরতে যেতাম। কিছু কিনতাম না। নানা আমাকে প্রতিদিন এক টাকা দিতেন। তখন এক টাকা অনেক টাকা। কাচারিতে ঘুরে ঘুরে দেখতাম বিচারকাজ চলছে। কিছুক্ষণ দেখে ইছামতির ধারে চলে যেতাম। সেখানে একটা পুরনো বাড়ি ছিল। তার ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করতাম। নানা অসুস্থ হওয়ার পরে আমরা চেঞ্জে (বায়ু পরিবর্তন) গেলাম। বিশাখাপত্নমে গিয়েছিলাম। সমুদ্রের ধারে খুব সুন্দর বাড়ি ছিল। সেখানে কিছুদিন থাকার পর রাঁচিতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই। ছোটবেলা থেকেই একটা অন্যরকম পরিবেশ পেয়েছি। বিদেশে তখন মুসলমান বলে হিন্দুরা কখনও ঘৃণা করত না, খুব আপন ভাবত। তারাই বরং আপদে বিপদে সাহায্য করেছে। আসলে মানুষের জাতটা কিছু না, আন্তরিকতাটাই বড় ব্যাপার।
ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা ছিলাম। কবিখালার কাছে থাকতাম। তার কাছেই ঘুমাতাম। তিনি আমাকে গান গাইতে গাইতে ঘুম পারাতেন। নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীতসহ সবরকম গান গাইতে পারতেন। খালা খুব প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। কলকাতার বড় বড় সাহিত্যিকদের সাথে খালার পরিচয় ছিল। সেখানে যখন বড় সাহিত্য সভা হত, খালা পাবনা থেকে যেতেন সাতিহ্য সভায় যোগ দিতে। দেশভ্রমণ করলে মানুষের মনটা প্রসারিত হয়, জাত-ধর্ম এসব নিয়ে সংস্কার চলে যায়।
আপনি তো একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
(হাসি) একুশে পদক — কি জানি, হঠাৎ পেয়ে গেলাম। কোনো দিন ভাবতে পারিনি যে আমি একুশে পদক পাব।
শিল্পী হিসাবে পুরস্কারপ্রাপ্তি আপনাকে কতটুকু অনুপ্রাণিত করেছে?
এটা তো সত্যি, পুরস্কার পেলে মানুষের উৎসাহ বাড়ে। আরও ভালো কাজ করার আগ্রহ পাওয়া যায়। নিজের প্রসার করার সঙ্গে সঙ্গে দেশেরও কিছু উপকার করার কথা ভেবেছি। আমাদের বাড়ির সবার মতোই আমার মধ্যেও দেশের জন্য কিছু করার চিন্তাটা ছিল। ছোটবেলায় বেশি কিছু বুঝতাম না, কিন্তু দেশের প্রতি একটা গভীর ভালোবাসা ছিল। সম্মান পেতে তো ভালোই লাগে। মানুষের ভালোবাসা পাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার।
সাক্ষাৎকার, লেখা ও ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল
Comments