র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার

‘গণস্বাস্থ্যের কিটের অনুমোদন দিলে জনগণের লাভ, বিদেশ থেকে আনলে কিছু ব্যক্তির লাভ’

করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে ও আরটি-পিসিআর পরীক্ষার চাপ কমাতে র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার। তিন মাস আগেই র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। তবে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত র‌্যাপিড টেস্টিং কিটের অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে ও আরটি-পিসিআর পরীক্ষার চাপ কমাতে র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার। তিন মাস আগেই র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। তবে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত র‌্যাপিড টেস্টিং কিটের অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পরীক্ষায় গণস্বাস্থ্যের অ্যান্টিবডি কিটের সর্বোচ্চ সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) পাওয়া গিয়েছিল ৬৯ দশমিক ৭ শতাংশ ও নির্দিষ্টতা (স্পেসিফিসিটি) ৯৬ শতাংশ। ঔষধ প্রশাসন জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) আমব্রেলা গাইডলাইনের আলোকে কিটের সর্বনিম্ন সংবেদনশীলতা ৯০ শতাংশ ও নির্দিষ্টতা ৯৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এফডিএ’র আমব্রেলা গাইডলাইন অনুসরণ করে নিজেদের উদ্ভাবিত অ্যান্টিবডি কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এতে দেখা গেছে, কিটটির সংবেদনশীলতা ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও নির্দিষ্টতা ৯৬ শতাংশ। পরবর্তীতে নিজেদের কিট আরও উন্নতও করেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও জমা দিয়েছে তারা। তবে, এখনো তাদের কিটের অনুমোদনের কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

সরকার র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে, গণস্বাস্থ্যের কিট এখনো অনুমোদন পায়নি। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?, জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘র‌্যাপিড টেস্ট করতে হবে, আমরা এ কথা বলছি ছয় মাস আগে থেকে। সরকারের উপলব্ধিতে তা আসতে ছয় মাস সময় লাগল। করোনার মতো ভয়াবহ মহামারি মোকাবিলায় ছয় মাস সময় নষ্ট করা হলো। অনেক দেরিতে হলেও র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে, এটা ভালো সংবাদ হতে পারত। কেন এ কথা বলছি? এতদিনে যদি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হতো। এখন হয়তো বিদেশ থেকে কিট কিনে আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তো বহু বছর ধরে কথা বলছি। সেখানে কেনাকাটা নিয়ে কী হয়, কী হচ্ছে, তা তো এখন দেশের মানুষ দেখছে। ধারণা করি, র‌্যাপিড টেস্ট কিট কেনার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সে কারণেই কিনে আনায় ব্যাপক আগ্রহ। দেশে উদ্ভাবিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিটের অনুমোদন দিলে জনগণের লাভ, বিদেশ থেকে কিনে আনলে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির লাভ। আমরা তো এই কিট দিয়ে ব্যবসা করব না। সামান্য পয়সার বিনিময়ে পরীক্ষা করব। গরিব মানুষ বিনা মূল্যে পরীক্ষার সুযোগ পাবেন।’

‘এটা একেবারেই দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ হচ্ছে না। দেশের প্রতিষ্ঠানে দেশীয় বিজ্ঞানীরা কিট উদ্ভাবন করলেন। কিন্তু, সেটার অনুমোদন দেওয়া হলো না। নানা রকমের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফেলে দীর্ঘসূত্রিতায় সেটাকে ঝুলিয়ে রাখা হলো। বিএসএমএমই কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষায় করে ৭০ শতাংশ কার্যকর ফল পাওয়ার পরেও আমাদের অনুমোদন দেওয়া হলো না। যদিও আমাদের কিটের কার্যকারিতার পরিমাণ আরও বেশি। পরবর্তীতে আমরা নিজেরা সেই কিট আরও উন্নত করলাম, পরীক্ষা করলাম। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, কিটের কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশেরও বেশি। আমাদের কিট ঠিকমতো পরীক্ষাও করা হলো না, অনুমোদনও দেওয়া হলো না। এখন শোনা যাচ্ছে সরকার র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দেবে। যে কিট দেশেই উদ্ভাবন করা হলো, দেশেই যেটির উৎপাদন সম্ভব, সেটি বাদ দিয়ে জনগণের অর্থ খরচ করে কেন কিট আমদানি করা হবে? একটা জনমুখী সরকার হলে এরকম কাজ করতে পারত না’, বলেন তিনি।

সরকার তো র‌্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে। এখন যেহেতু গণস্বাস্থ্যের কিট অনুমোদন পেল না, তাই আমদানিই করবে। সেটাই তো স্বাভাবিক?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার আমদানি করবে, করুক। তাহলে আমাদের কিট যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করা হয়েছে, আমদানি করা কিটও সেই প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করুক। দেশের প্রতিষ্ঠানে দেশীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত কিট জটিল প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করা হবে, উত্তীর্ণ হওয়ার পরও অনুমোদন দেওয়া হবে না, আর বিদেশ থেকে কিট এনেই পরীক্ষা করা হবে? বিদেশ থেকে কিট আনলেই সেটা ভালো, আর দেশে উদ্ভাবিত হলেই সেটা খারাপ, এই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। এটা ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা আমরা যুগ যুগ ধরে ধারণ করছি। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হওয়া দরকার।’

‘আর সত্যিই যদি বিদেশ থেকে কিট আমদানি করা হয়, আর আমাদের কিটের অনুমোদন না দেয়, তাহলে আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছে আমরা আর্জি জানাব, দেশের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যা করা হচ্ছে, এটা আদালত সঠিক মনে করেন কি না। আদালত কী মনে করেন এই বিষয়ে। সেখানে আমরা সঠিক বিচার চাইব’, বলেন তিনি।

আপনাকে নিয়ে তো আলোচনা চলছেই, এর মধ্যে আপনার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। সেই মামলা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি জানেন এটা?, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, গতকাল আপনাদের থেকেই জেনেছিলাম। আর আজ পত্রিকাতেও দেখলাম।’

এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের গরিব মানুষের জন্য একটা হাসপাতাল করছি। সেটার জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে ২৫ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারসহ হাসপাতাল করতে যাচ্ছি। গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে সেই হাসপাতালে। সেই চট্টগ্রাম থেকেই কেউ একজন আমার নামে মামলা করেছেন। এখানে প্রথম কথা, বিষয়টি দুঃখজনক। দ্বিতীয়ত, এই মামলার কোনো গুরুত্ব নেই। এটি আমার কাছে কোনো আলোচনা বা চিন্তার বিষয় না। কারণ, আমার জায়গায় আমি খুব পরিষ্কার। আমি সব সময় সত্য ও সঠিক বলার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রেও তাই বলেছি। আমি কখনো কোনো অবস্থাতেই কোনো ধর্ম বা কোনো ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে কিছু বলি না। এখনো কোনো ধর্ম বা কোনো ব্যক্তিকে অসম্মান করিনি। সুতরাং যে মামলা করা হয়েছে, সেটা কোনো ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।’

‘এই মামলা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত না। এর কোনো গুরুত্বও আমার কাছে নেই। নিজে সুস্থতা আর অসুস্থতার মাঝে আছি। হাসপাতাল থেকে বাসা, বাসা থেকে হাসপাতালে যাওয়া-আসার মধ্যে আছি। এটা নিয়ে এক ধরনের চিন্তার মধ্যে আছি। কারণ, যে সময় সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, যে সময় মানুষের জন্য অনেক কিছু করা দরকার, এ সময় নিজের চিকিৎসার বিষয়ে ভাবতে হচ্ছে, হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। এটা নিয়ে মানসিক কষ্টে ভুগছি। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। মানুষের জন্যে তো আরও অনেক কিছু করা বাকি। এটাই আমার কাছে চিন্তার বিষয়, মামলা নয়। পুলিশকে তদন্ত করতে বলেছে, তদন্তে নিশ্চয়ই সত্যটাই পাওয়া যাবে। তখন দেখা যাবে, আমি কোনো অসত্য কথা বলিনি কিংবা কোনো ধর্ম বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলিনি’, যোগ করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

দেশে করোনার সংক্রমণের শুরু থেকেই কিটসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেও করোনায় আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন নিজের প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি করোনামুক্ত হলেও কোভিড-উত্তর ফুসফুসের নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। যা এখনো পুরোপুরি সারেনি। এ ছাড়া, বেশ আগে থেকেই তিনি কিডনি রোগী। সম্প্রতি হৃদরোগসহ বেশকিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাকে নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কয়েকদিন আগে হৃদরোগ সংক্রান্ত শারীরিক সমস্যা অনুভূত হলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক দিন ভর্তি ছিলেন। যাবতীয় পরীক্ষা করা হয়েছে। তার চিকিৎসায় ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল।

ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ধারণা করা হচ্ছে, করোনার কারণে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর লিভারও কিছুটা আক্রান্ত। সবমিলিয়ে তার শারীরিক অবস্থা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। তবে, নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এখন ভালো হয়ে গেছি। কোনো সমস্যা নেই। অসুখ নিয়ে এত চিন্তা করলে কাজ করব কখন? এখন বের হতে হবে, কাজ করতে হবে।’ কিন্তু, তার প্রকৃত শারীরিক অবস্থা বেশ ‘নাজুক’ বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

এ বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী, নারী নেত্রী শিরীন হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চিকিৎসকরা যা বলেন, আর তার শারীরিক অবস্থা যা হয়, তার জীবনাচরণে এর প্রমাণ কখনই ছিল না, এখনো নেই। তিনি মূলত মানসিক শক্তির জোরে কাজ করেন, চলেন। শরীর পারমিট না করলেও তিনি থেমে থাকেন না। মন দিয়েই কাজ করেন। এখন তার অনেক বেশি বিশ্রামে থাকা দরকার, কথা কম বলা দরকার। কিন্তু, তিনি এর কোনোটাই করছেন না। তিনি এখনো মানুষের জন্য কাজ করছেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আরও কী করবেন, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় আছেন। সব সময়ের মতোই এভাবে মানসিক শক্তির জোরে তিনি চলছেন।’

আরও পড়ুন:

প্রমাণ করেছি যে, মানসিকভাবে আমরা উন্নত না: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

চট্টগ্রামে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ‘গরীবের হাসপাতাল’

আমরা প্লাজমা সেন্টার চালু করতে যাচ্ছি: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ভূতের প্রবেশ ঘটেছে’

আমাদেরই সবার আগে এই কিট বিশ্ববাসীর সামনে আনার সুযোগ ছিল: ড. বিজন

গণস্বাস্থ্যের কিট, বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে দেশীয় রাজনীতি

২৫ দিনে ৩০১ শয্যার করোনা হাসপাতালের জন্ম অথবা অপমৃত্যু!

মুক্তিযুদ্ধ, গণস্বাস্থ্য, ডা. জাফরুল্লাহ ও মাছ চোর

Comments