কুড়িগ্রামে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ শিক্ষক আমিনুর রহমান

আমিনুর রহমান বয়স ৫০ বছর ছুঁই ছুঁই। পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কোদালকাটি ইউনিয়নে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটিতে নিজ উদ্যোগে খাবার স্যালাইন বিতরণ করছেন শিক্ষক আমিনুর রহমান। ২৩ আগস্ট ২০২০। ছবি: স্টার

আমিনুর রহমান বয়স ৫০ বছর ছুঁই ছুঁই। পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কোদালকাটি ইউনিয়নে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।

চর রাজিবপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন রাজিবপুর, কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ। তিনটি ইউনিয়নই ব্রহ্মপুত্রের তীরে। বন্যা, ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার এই উপজেলার বাসিন্দারা।

শিক্ষক আমিনুর রহমানও ব্রহ্মপুত্র নদের চরের বাসিন্দা। কিন্তু, এলাকায় তিনি ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিনি বাড়িতে নিজের পরিবার সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন না। নিজের পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি।

আমিনুর রহমান ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে স্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে, যুবকদের সংগঠিত করে নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে নিজ উদ্যোগে নির্মাণ করেন বাঁশের পাইলিং। এতে প্রাথমিকভাবে নদের ভাঙন ঠেকিয়ে ভাঙনকবলিত মানুষজনকে নিরাপদে বসবাস করতে সহায়তা করেন তিনি। উপজেলার সবগুলো ইউনিয়নে রয়েছে তার এ রকম কাজের উদাহরণ।

বন্যার সময় তার দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকগুণ। ব্রহ্মপুত্রের দুর্গম চরে পানিবন্দিদের খোঁজ নিতে কেউ না আসলেও আমিনুর রহমান নিজ দায়িত্বে তাদের পাশে ছুটে যান। তাদের খোঁজখবর নেন। তাদের হাতে তুলে দেন চিড়া, মুড়ি, গুড়, পাউরুটি, মোমবাতি ও দিয়াশলাই।

তিনি নিজের অর্থায়নে এসব করে থাকেন। প্রয়োজনে পরিবারের লোকজন, আত্মীয়দের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমনকি রাতেও তিনি বানভাসিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

বানের পানি নেমে গেলেও থেকে যায় না তার কাজ। বানভাসিরা যখন পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হন তখন আমিনুর রহমান তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। নিজের টাকায় খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট কিনে দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের মাঝে বিতরণ করেন।

খুব বেশি অসুস্থ হলে তিনি তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করে দেন। চর রাজিবপুর থেকে সঙ্গে করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে এনেও অনেক রোগীকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে ফিরেছেন তিনি।

এছাড়া, কোথাও কোনো অভুক্ত-অসুস্থ মানুষ থাকলে সে সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটে যান। নিজের সাধ্য মতো তাদের সহায়তা করেন।

চরের শিশুদের শিক্ষিত করতে তিনি চরাঞ্চলে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সচেতন করেন। শিশু-কিশোর সঙ্গে লেখাপড়ার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। যুবকদের সংগঠিত করেন সমাজের উপকার করার জন্য।

চর রাজিবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম চরাঞ্চল চর শংকর মাধবপুরের বানভাসি রাহেলা বেওয়া (৬৫) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বন্যার সময় কেউ আমার খবর না নিলেও্ আমিনুর মাস্টার পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুকনো খাবার দিয়েছেন।’

ব্রহ্মপুত্রের দুর্গম চর সাজাইয়ের বানভাসি কৃষক আক্কাস আলী (৬০) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের লোকজন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর আমিনুর মাস্টার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাবার স্যালাইন ও ওষুধ কিনে দিয়েছিলেন।’

চর বিলপাড়ার বানভাসি কৃষক হাসেম আলী (৫৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি অসুস্থ হলে আমিনুর মাস্টার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। গ্রামের সবার প্রতি তার মমতা রয়েছে।’

চর উত্তর কোদালকাটির যুবক শফিকুল ইসলাম (২০) ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমিনুর স্যার ভালো মানুষ। তিনি গ্রামের যুবকদের ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি সবাই নিয়ে সমাজের ভালো করে যাচ্ছেন।’

চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের চর সাজাই মণ্ডলপাড়া গ্রামের মৃত নূরুল ইসলাম মণ্ডলের ছেলে ও শিক্ষক আমিনুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি ছাত্রজীবন থেকে সমাজের এ কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত। এসব করতে ভালো লাগে।’

‘জন্ম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের চরে বেড়ে উঠা তাই মানুষের কষ্টগুলো কাছ থেকে দেখছি’ উল্লেখ করে তিনি জানান, তার নিজের কিছু আবাদ আছে। তা দিয়েই সংসার চলে।

চাকরি থেকে আয়ের অর্ধেক টাকাই তিনি সমাজের কাজে খরচ করেন বলেও জানান। বলেন, ‘আমার স্বপ্ন আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন ব্রহ্মপুত্র পাড়ের অসহায় মানুষদের পাশে যেন দাঁড়াতে পারি। তাদের কষ্ট লাঘবে নিজেকে যেন বিলিয়ে দিতে পারি।

জনসেবার কাজে পরিবারের লোকজন তাকে সবসময় সহায়তা করেন বলেও জানান স্থানীয়ভাবে ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত শিক্ষক আমিনুর রহমান।

Comments

The Daily Star  | English

Abu Sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago