আরও আইন করে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচতে পারব?

ঢাল হিসেবে কয়েকটি কোম্পানির নাম ব্যবহার করে এবং এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে প্রশান্ত কুমার হালদার পাচার করেছেন অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। সেই টাকায় তিনি এখন কানাডায় আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন। পি কে হালদার তার টাকা পাচার করতে গিয়ে চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন তিনি ব্যাংকের পরিবর্তে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিলেন? এর উত্তর হতে পারে, আমাদের অনেক ব্যাংকের ভল্ট হয়ত ইতিমধ্যে খালি হওয়ার পথে।

ঢাল হিসেবে কয়েকটি কোম্পানির নাম ব্যবহার করে এবং এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে প্রশান্ত কুমার হালদার পাচার করেছেন অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। সেই টাকায় তিনি এখন কানাডায় আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন। পি কে হালদার তার টাকা পাচার করতে গিয়ে চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন তিনি ব্যাংকের পরিবর্তে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিলেন? এর উত্তর হতে পারে, আমাদের অনেক ব্যাংকের ভল্ট হয়ত ইতিমধ্যে খালি হওয়ার পথে।

গত ১৬ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী ১৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা উদ্ধারে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই টাকা দেশের ব্যাংকগুলো থেকে পাঁচটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাতে রয়েছে খেলাপি ঋণের বিরাট চাপ।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে হওয়া মামলায় মূল সন্দেহভাজনদের আসামীই করা হয়নি। এই যদি হয় বাস্তব পরিস্থিতি, তাহলে সত্যিই কি পি কে হালদারকে দোষ দিতে পারেন? যদি এভাবেই এই  কুশীলবরা পার পেয়ে যায়, তাহলে  বাজি ধরে বলতে পারি যে পি কে হালদার ভেবেছিলেন, ‘আমি কেন করবো না? আমিই বা কুটিলতায় কম কিসে?’ জনগণের সম্পদ লুণ্ঠিত হচ্ছে দেখেও যখন আপনি চুপচাপ থাকবেন, তখন এমনটাই ভবিতব্য।

এ বছরের ৮ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন পি কে হালদারের নামে মামলা করেছে। অভিযোগ, অপ্রদর্শিত সূত্র থেকে প্রায় ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার সম্পদ আয় করেছেন তিনি। বিষয়টি আরও গভীরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, পি কে হালদার তার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে কোনো প্রকার জামানত ছাড়াই প্রচুর পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। এই সুবিধা ‘সম্ভবত’ তিনি পেয়েছেন, এসব প্রতিষ্ঠানে তার নামে শেয়ার থাকার কারণে।

একই রকম দুর্নীতি হয়েছিল আরেকটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফাস্ট ফাইন্যান্সে। প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তার বাধ্যতামূলক নগদ অর্থও জমা রাখতে পারেনি। এরকম দুর্নীতি ফারমার্স ব্যাংককে প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছে। (“Banking Sector: A house of cards”, দ্য ডেইলি স্টার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭)। তারপরও মনে হয়েছে, আমাদের ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রকরা এসব থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। এর দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথমত, তাদের জ্ঞানার্জনের সক্ষমতা খুবই কম (এর খুব একটা সম্ভাবনা নেই)। আর দ্বিতীয়ত, তারা শিখতে চায় না (এই সম্ভাবনা বেশি)।

পি কে হালদারের পক্ষে একা এই সব অপরাধ করা সম্ভব নয়। তার মতো দু-একজন সহকর্মী নিয়েও এই অপরাধ সম্পন্ন করা সম্ভব না। স্পষ্টতই তার সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন। এ প্রসঙ্গে দুদক একাধিক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে। আশা করি সব টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরাও পালিয়ে যাওয়ার আগেই দুদক অপরাধীদের ধরে ফেলবে।

এত বিপুল পরিমাণ টাকা আমাদের দেশ থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমাদের সিস্টেমে কিছু ভুল আছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় মোতাজারুল ইসলাম মিঠুর ঘটনাটি। দুদকের ভুলের কারণে লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজ এবং মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নামে স্বাস্থ্য খাতের দরপত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এই মানুষটি দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ পায়। ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য খাতে অসঙ্গতি ধরা পরার পর মিঠুর সম্পদের বিবরণী জমা দিতে বলে দুদক। কিন্তু দুদকের সেই নোটিশের জবাব দেননি মিঠু।

এরপর, তার সিন্ডিকেট শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কোনো চিকিত্সা সরঞ্জাম সরবরাহ না করেই প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানা যায় ৩০ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জারি করা এক চিঠি থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অনলাইন রিয়েল এস্টেট তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে ছয় কোটি ছয় লাখ টাকা ( আট লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার) দিয়ে একটি ভিলা কিনেছেন মিঠু। দুদক যদি আরও বেশি সক্রিয় হতো তাহলে হয়তো মিঠুর এই দুর্নীতির তথ্য আরও অনেক আগেই ফাঁস হতো। তবে, দুদকের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মিঠু সম্পদের পাহাড় গড়ে এবং ২০১৬ সালে তার নাম পানামা ও প্যারাডাইজ পেপারস ফাঁসে প্রকাশ পায়।

একটি গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি প্রতিবেদনে বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থ পাচারে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বাংলাদেশকে স্থান দিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে দেশের অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি। এতে বলা হয়েছে, আনুমানিক প্রায় তিন দশমিক এক বিলিয়ন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হচ্ছে। এর সমাধানে সরকার শিগগির কঠোর কর বিধি করবে বলে আশা করি। তবে সেটাই কি যথেষ্ট? যারা ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা’ থাকার কারণে লুট করার সুযোগ নিচ্ছে এবং সেই টাকা পাচার করছে, তাদের তাদের কী হবে?

সমস্যা শুধু কঠোর আইনের অভাব নয়, সমস্যা আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিবিদ ট্যাসিটাস বলেছেন, ‘রাষ্ট্র যত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হবে, তত বেশি আইন হবে’। বাংলাদেশ এই উক্তিটির যথাযোগ্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত ‘রাজনৈতিক সংযোগ’ আছে তা ভুলে ‘কিছু’ মানুষের প্রতি কর্তৃপক্ষ কঠোর না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করা বন্ধ হবে না। এতে  করদাতাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে যাবে, ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

শুধু অপরাধীদের দায়বদ্ধ করলে চলবে না। নিয়ন্ত্রকরা যদি ‘সময়মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়’ বা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে না পারে, তাহলে তাদেরও অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে বিচারের আওতায় আনতে হবে তাদের, যারা নিয়ন্ত্রকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। কারণ, এই প্রভাব বিস্তার করার কারণেই আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নখ-দন্তহীন বাঘে পরিণত হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago