করোনাভাইরাসে মৃত্যুর আগেই সংবাদমাধ্যমকে বাঁচাতে হবে

‘এমন একটি পৃথিবীর কথা ভাবুন যেখানে সাংবাদিকতা বলতে কিছু নেই’, এপ্রিলের শুরুতে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক সুজি বোনিফেস তার এক লেখায় পাঠকদের এই আহ্বান জানান। কেমন হবে সেই পৃথিবী? বোনিফেসের ভাষায়, সেটি হবে এমন এক পৃথিবী যেখানে আইন-কানুনের কোনো বালাই নেই। এমন এক পৃথিবী যেখানে জ্ঞান আরোহন, তথ্য যাচাই-বাছাই, গণতন্ত্র কিংবা সমাজ পরিবর্তনের ধারণাগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।
Newspaper_31Aug20.jpg
ঢাকার রাস্তায় সংবাদপত্র পড়ছেন কিছু মানুষ। ছবিটি ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তোলা। ছবি: এএফপি/ইন্দ্রানী মুখার্জী

‘এমন একটি পৃথিবীর কথা ভাবুন যেখানে সাংবাদিকতা বলতে কিছু নেই’, এপ্রিলের শুরুতে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক সুজি বোনিফেস তার এক লেখায় পাঠকদের এই আহ্বান জানান। কেমন হবে সেই পৃথিবী? বোনিফেসের ভাষায়, সেটি হবে এমন এক পৃথিবী যেখানে আইন-কানুনের কোনো বালাই নেই। এমন এক পৃথিবী যেখানে জ্ঞান আরোহন, তথ্য যাচাই-বাছাই, গণতন্ত্র কিংবা সমাজ পরিবর্তনের ধারণাগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।

মিরর অনলাইনের প্রকাশিত এই নিবন্ধে বোনিফেস আরও বলেন, ‘আমরা নিখুঁত নই। আমরা আপনার প্রিয় মানুষ নই। আমরা কখনোই আপনার কাছে ধন্যবাদ চাই না, আমরা কেবল চাই আপনি ভাববেন।’

করোনা মহামারি আমাদেরকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব, জিনোম ম্যাপিং, ভ্যাকসিন তৈরি ও বিজ্ঞানের গুরুত্ব নতুন করে বুঝতে শিখিয়েছে। পাশাপাশি বুঝিয়েছে সাংবাদিকতা পেশাটির গুরুত্ব। আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, সংবাদপত্র আপনার জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ।

সুজি বোনিফেসের এই বক্তব্য সংবাদকর্মীদের অনুপ্রেরণা দেয়, সমর্থন জানায়। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সমাজ বা মানবতার জন্য অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও করোনার ধাক্কা সামলানোর মতো ভিত এই পেশার নেই। অন্যান্য দেশের মতো করোনা মহামারি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের শক্তি ও দুর্বলতার ওপর চাপ তৈরি করছে, যার পরিণতি ধ্বংসাত্মক।

গত ২১ আগস্ট নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এর এক বিবৃতি থেকে আমরা এই পরিস্থিতির একটি চিত্র পাই।

নোয়াব জানিয়েছে, সংবাদপত্র শিল্প প্রায় ধ্বংসের পথে। কারণ সংবাদপত্রের বিক্রি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, মহামারির কারণে পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। বিজ্ঞাপন থেকে আয়ও কমেছে সমানভাবে।

লোকসানের কারণে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক পত্রিকার মুদ্রণ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে চালু করেছে অনলাইন সংস্করণ। আছে কর্মী ছাঁটাই, অনিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ না করা ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো। লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে অনেক পত্রিকাই পাতা কমিয়ে আনছে, মুদ্রণের সংখ্যা কমছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কর্মী ছাঁটাই করেছে।

গত ৩ জুলাই প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের বরাতে জানানো হয়, জুন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর কারণে ঢাকাসহ আটটি বিভাগীয় শহরে মোট ২৫৪টি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে।

আগস্টের শেষ দিকে এসেও আমরা মহামারির প্রকোপ কমে যাওয়ার বদলে প্রতিদিনই শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে দেখছি। বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকা বা প্রকাশনার সংখ্যাও বাড়ছে একই হারে। এ ছাড়া, করোনার ধাক্কায় আর্থিক সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল সুরক্ষা আইনসহ বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতা ও হয়রানি।

গত ২৪ আগস্ট সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে জানায়, ‘সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের জন্য কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।’

আমরা এসব বিবৃতি কিংবা প্রতিবেদন থেকে একটি সামগ্রিক চিত্র পেলেও সাংবাদিকদের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা আমরা জানতে পারি না।

আপনি যদি কখনো এই হয়রানি, এই দুর্ভোগের গল্পে নিজেকে কল্পনা করেন, তখন আপনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জীবন আসলে কতটা অনিশ্চিত। আপনি বুঝতে পারবেন সংবাদপত্র শিল্পের নিচ থেকে মাটি কত দ্রুত সরে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী এই সংকটকালে যখন সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো জীবনবাজি রেখে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তখনো তারা প্রাপ্য নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত।

সাংবাদিকরা যখন মাঠ পর্যায়ে কাজ করে সংবাদ সংগ্রহ করছেন, মানুষের জীবন বাঁচাতে মহামারি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন, তখনো তাদের নিজস্ব জীবন-জীবিকা অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। এমনকি সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজেও তাদেরকে বিবেচনা করা হয় না।

নির্বাকদের কণ্ঠ দিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর নিজেদের জীবনের গল্প আড়ালেই থেকে যায়। এটি কেবল ভাগ্যের নির্মম পরিহাস না। এটি সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীদের প্রতি বছরের পর বছর ধরে চলা অবহেলা, নানা প্রতিকূলতা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি সামগ্রিক ফলাফল।

বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য নোয়াবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি জানানো হয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।

রুগ্ন শিল্পে পরিণত হওয়া সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে নোয়াব। বর্তমানে আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর টিডিএস চার শতাংশ এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর এআইটি পাঁচ শতাংশসহ মোট নয় শতাংশ ধরা হয়েছে। অধিকাংশ সংবাদপত্রের মোট আয়ের নয় শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। এই পরিস্থিতিতে টিডিএস চার থেকে দুই শতাংশ এবং এআইটি পাঁচ শতাংশের বদলে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করেছে নোয়াব।

এমনকি সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি ভাতা ও স্বাস্থ্য বীমার মতো বিষয়গুলোও বিবেচনা করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাংবাদিকসহ প্রথম সারির কোভিড-১৯ কর্মীদের জন্য ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বীমা বাড়িয়েছে।

সাংবাদিকতা জনসাধারণের জীবনে একটি অতি প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। সংবাদশিল্প যদি দুর্ভোগে থাকে তাতে ক্ষতি হয় গণতন্ত্রের। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেসব মানুষ যাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সবার কাছে তুলে ধরা জরুরি। সংবাদকর্মীরাই এই ঘটনাগুলোকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়, আমাদের স্মরণে রাখতে সাহায্য করে।

তবে বর্তমান সংকট এটাও প্রমাণ করেছে যে, সরকারের সমর্থন বা এর অভাবই সংবাদপত্রের জন্য একমাত্র সমস্যা না।

সাংবাদিকদের ছাঁটাই হওয়ার বিষয়টি আমাদের সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়। তবে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা যদি সময় ও বাস্তবতা বুঝে নিজেদের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা বিবর্তনের মুখোমুখি না করি, তাহলে সামনে আরও অন্ধকার দিন আসতে পারে। কোভিড-১৯ সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে ‘বৃহত্তম অস্তিত্বের সংকট’ তৈরি করেছে এটা সত্যি, তবে সংকটের ভিত্তি কিন্তু তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাংলাদেশে এই শিল্পটিতে দীর্ঘকাল ধরে উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক মডেলের পাশাপাশি মানসম্পন্ন প্রতিবেদনের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থাগুলো ছাড়া বাকি সব পত্রিকাই বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞাপনের আয় থেকেই মূলত সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। যখন কোনো শিল্পের আয়ের মূল উত্স তার ভোক্তা বা পাঠক নন, বরং বিজ্ঞাপনদাতার তখন সে শিল্পের শক্ত ভিত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিজ্ঞাপনদাতারা যখন সমস্যায় পড়েন, স্বাভাবিকভাবেই যারা তাদের ওপর নির্ভরশীল তারাও সমস্যায় পড়তে বাধ্য। এমন দুর্বল অর্থকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতাই বা আমরা কীভাবে আশা করতে পারি?

এই কারণে মহামারির সময়ে অনলাইনে রেকর্ড সংখ্যক পাঠকের ভিড় ও সম্পৃক্ততা থাকলেও আমাদের সংবাদপত্রগুলো টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে।

মহামারি থেকে সংবাদপত্রগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এই জাতীয় বাহ্যিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেড়ে উঠতে বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে গ্রাহকদের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যার মূল উত্স হবে রাজস্ব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা করার একটা উপায় হলো গ্রাহকভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলকে প্রসারিত করা।

উদাহরণ হিসেবে নিউইয়র্ক টাইমসের কথা বলা যায়। কোভিড-১৯ এর মধ্যে পত্রিকাটি সংকটে পড়া সত্ত্বেও তারা অভূতপূর্বভাবে সফল হয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এর ডিজিটাল গ্রাহকের সংখ্যা ৬০ লাখ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশের অনেক সংবাদসংস্থার ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন বেড়েছে।

গ্রাহকভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেল দাঁড় করানোর জন্য সবার আগে পত্রিকার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইনে লিখিত বা ভিজুয়াল মাধ্যমে উপস্থাপিত প্রতিবেদন (ও নিবন্ধ) মানসম্পন্ন হলে, পাঠক তার জন্য অর্থ খরচ করতে আগ্রহী হবে। ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন বাড়বে। এখানেই বর্তমান সংকট আমাদের আরও ভালো সাংবাদিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ দেয়। সংবাদ শিল্পের রুগ্নাবস্থা কাটিয়ে উঠা এবং আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার সুযোগ এটাই।

এই মুহূর্তে সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে আরও অনেক কিছু করতে হবে। সংবাদশিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত কেবল তারাই নয়, প্রয়োজনীয় আর্থিক ও নীতিসংক্রান্ত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে ফেসবুক ও গুগলের মতো প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকেও। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

বদিউজ্জামান বে

দ্য ডেইলি স্টার-এর এডিটোরিয়াল টিমের সদস্য 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Public medical colleges: 86 doctors, 136 students punished since August 5

Over the last two months, at least 86 physicians and 136 students in eight public medical colleges and hospitals across the country have faced different punitive actions on various allegations, including “taking a stance against” the quota reform movement.

8h ago