চরের জীবন ‘ভাঙা আয়না’র মতো

চরের জীবনকে ‘ভাঙা আয়না’র মতো বলে আখ্যায়িত করেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের বাসিন্দা আঞ্জু আরা বেওয়া (৬২)। ছবি: এস দিলীপ রায়

চরের জীবনকে ‘ভাঙা আয়না’র মতো বলে আখ্যায়িত করলেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের বাসিন্দা আঞ্জু আরা বেওয়া (৬২)। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের চর খরখরিয়া’র এই বিধবা বলেন, ‘ভাঙা আয়নায় যেমন মুখের কোনো কোনো অংশ দেখা যায় না, আবার দেখা গেলেও বোঝা যায় না, চরের জীবনও তেমন। চরের মানুষকে দেখলে বোঝা যায় না তিনি খেয়েছেন কিনা। এমনকি বসবাসের জায়গা আছে কিনা তাও বোঝার উপায় নেই।’

চার সন্তানের মা আঞ্জু আরা বছর দশেক আগে স্বামী সৈয়দ আলীকে হারিয়েছেন। এখন নদীপাড়ে সন্তানের সংসারে বাস করছেন। আর ঘর তুলেছেন অন্যের জমির উপর। নিজের বলতে এখন কিছুই নেই। একসময় বসতভিটা ছিল, আবাদি জমি ছিল, গোয়ালঘর ছিল, ফলের বাগান ছিল। সবমিলিয়ে সুখ ও সমৃদ্ধে ভরা জীবন ছিল আঞ্জু আরা বেওয়ার।

জীবনে ৪০-৪৫ বার বানের পানিতে বসতভিটা হারানোর গল্প নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। আর চোখে-মুখে লেগে শুধু বেদনার ছাপ। মাঝে মাঝে না খেয়েই দিন কাটাতে হয় তাকে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমগো জীবনটা ভাঙা আয়নার মতো হইয়া গ্যাছে। না খ্যায়া থাকলেও কেউ জিগায় না।’

আঞ্জু আরা বেওয়ার জীবন গল্পের মতোই কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের চর কোদালকাটির সুবেছান বেওয়ার (৬৭)। ২৫ বছর আগে স্বামী হারেছ মিয়াকে হারিয়েছেন তিনি। দুই সন্তান নিয়ে বেঁচে আছেন সুবেছান বেওয়া।

তিনি বলেন, ‘আংগো ঘরে ভাঙা আয়না থাকে। আংগো দুঃখ কষ্টের শেষ নেই। আংগো জীবনটাই ভাঙা আয়নার মত।’

জীবনে ৪০ বারের বেশি বসতভিটা হারিয়েছেন এই নারী। বসতভিটা, আবাদি জমি সবকিছুই ব্রহ্মপুত্র নদে হারিয়ে চরে অন্যের একখণ্ড জমিতে ঘর করে বাস করছেন তিনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা নদীর চর বাগডোরার বাসিন্দা ময়না বেওয়া (৫৮)। তিনি জানান, ভাঙা আয়নায় যেমন কেউ মুখ দেখতে চায় না, তেমনি চরের মানুষকেও কেউ দেখতে চায় না। চরের জীবন কষ্টের তবুও চরে থাকতে হয় কারণ চরের সঙ্গে মিশে গেছে জীবনের গল্পগুলো। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখার মতো চরের কষ্টময় জীবন নিয়ে বাঁচতে হয় বেঁচে থাকার প্রয়োজনে।

ময়না বেওয়া বলেন, ‘হামার বাড়ি ভিটা নাই। জমা টাকা নাই। হামরা বাঁচি অনিশ্চিত জীবন নিয়ে।’

কুলাঘাট ইউনিয়নের ধরলা নদীর চর শিবেরকুটির দিনমজুর নজের আলী (৬৫) জানান, তারা চর ছাড়া থাকতে পারবেন না, কারণ তারা নৌকা চালাতে পারেন কিন্তু রিকশা চালাতে পারেন না। তারা সাতার কাটতে পারেন কিন্তু গাড়িতে চড়তে পারেন না। তারা রোদে পুড়ে মাঠে কাজ করতে পছন্দ করেন, কিন্তু ছায়ায় থাকতে পারেন না। বন্যা, নদীভাঙনে সবকিছু হারানোর বেদনা থাকলেও চরের অন্ধকারই তাদের কাছে শান্তির জীবন।

চরের জীবন নিয়ে কাজ করে কুড়িগ্রামে একটি এনজিও প্রতিনিধি অরুণ কুমার অধিকারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ বিভিন্ন নদ-নদীকে ঘিরে প্রায় ৫০০ চর রয়েছে। এসব চরে চার লক্ষাধিক মানুষ বাস করেন। চরের প্রত্যেকটি পরিবারের সঙ্গে মিশে আছে জীবনের বাস্তব গল্প।’

চরের মানুষ তাদের জীবনকে ভাঙা আয়নার সঙ্গে তুলনা করার ব্যাপারে অরুণ কুমার অধিকারী বলেন, ‘ভাঙা আয়নায় মানুষ মুখ দেখতে চায় না, একইভাবে নানা কষ্টেও চরের মানুষ চর ছাড়তে চায় না। চরের জীবন সংগ্রামের হলেও এ জীবনের সঙ্গে চরের মানুষ মিশে গেছে এবং এখানেই তারা প্রশান্তি লাভ করেন।’

Comments

The Daily Star  | English

IMF loan tranches: Agreement with IMF at last

The government has reached a staff-level agreement with the International Monetary Fund for the fourth and fifth tranche of the $4.7 billion loan programme, putting to bed months of uncertainty over their disbursement.

8h ago