আগরতলার দূষিত পানি ঢুকছে আখাউড়ায়
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা শহরে ভূগর্ভস্থ কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে, গত কয়েক দশক ধরে সেখানকার হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা, গৃহস্থালির বর্জ্য ও নর্দমার দূষিত পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে।
এই দূষিত পানি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে নদীর পানির সঙ্গে মিশে আখাউড়ার জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী ১৫ গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়িয়েছে। এসব গ্রামের অন্তত ১৫শ হেক্টর ধানের জমি এই পানি দিয়ে সেচ দিতে হয়। ফলে, এসব জমির উর্বরা শক্তিও দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।
আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর পিলখানায় অনুষ্ঠিতব্য দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর অর্ধ-বার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশ অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই বিষয়টিও উত্থাপন করবে।
স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, আগরতলার ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ডাইং কারখানা, চামড়া কারখানা, মেলামাইন কারখানা ও বাসাবাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনসহ বিভিন্ন বর্জ্য মিশে সেখানের পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। এই পানি কুচকুচে কালো আর উৎকট গন্ধযুক্ত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আখাউড়া স্থলবন্দরের পাশের সেনারবাদি খাল এবং কালিকাপুর গ্রামের জাজি নদী দিয়ে ওপারের আগরতলা শহর থেকে নেমে আসে ওই দূষিত পানি। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একাধিকবার এই পানি পরীক্ষা করা হয়েছে।’
‘ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ- সীসা, সালফার, দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও আয়রনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এই পানিতে,’ বলেন মমিনুল।
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কালাম ভূঁইয়া বলেন, ‘এক সময় মিঠা পানির অন্যতম উৎস ছিল এই খালের পানি। অথচ এলাকাবাসী এখন এই খালকে ‘কালন্দী’ (কালো পানির খাল) নামে ডাকে।’
বিষাক্ত এ পানি বাংলাদেশে প্রবেশের আগে পরিশোধন করতে ইফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কিছুই করেনি ত্রিপুরা রাজ্য সরকার। ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি আখাউড়া স্থলবন্দরের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পানীয় জল ও স্বাস্থ্যবিধি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী রাম কৃপাল যাদব ইটিপি স্থাপনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। চার বছর পার হয়েছে, কিন্তু সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা জানান, প্রায় ১৫ ফুট প্রশস্ত এই খালের পানিতে বিষাক্ত কেমিকেল বর্জ্য, স্যুয়ারেজ বর্জ্য, পলিথিন ও বিভিন্ন খাবারজাত প্যাকেট, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও কাঁচের বোতল এবং অন্যান্য পচনশীল দ্রব্যের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চেকপোস্ট সংলগ্ন খালটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পর তিতাস নদীতে যুক্ত হয়েছে। খালটির চার পয়েন্ট থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (Dissolved Oxygen) স্তর খুব কম পাওয়া যায়। এ ছাড়াও, সিসা, সালফার. দস্তা, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যাডমিয়াম ও আয়রনের মতো ভারী রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আখাউড়া স্থলবন্দর সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ড থেকে সিঅ্যান্ডবি খাল দিয়ে নামছে ওই পানি। এছাড়া সীমান্তবর্তী কালিকাপুর গ্রামের জাজি নদী দিয়েও আসছে এই দূষিত পানি। নদীর পানি মোগড়া ইউনিয়নের ধাতুর পহেলা আর নয়াদিল গ্রাম দিয়ে এবং খালের পানি আখাউড়া পৌর এলাকার তারাগণ গ্রাম হয়ে দেবগ্রাম দিয়ে এবং শহরের প্রধান সড়কের পাশ ধরে নেমে এসে মিশে যাচ্ছে তিতাস নদীতে।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এই কালো পানি আখাউড়া উপজেলার সদর দক্ষিণ ইউনিয়ন ও মোগড়া ইউনিয়ন এবং পৌরসভার একটি অংশের পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে কর্মরত বিজিবি’র জওয়ানরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সেনারবাদি খালের পাড়ে তাদের ক্যাম্প হওয়ায় দিনভর উৎকট এই দুর্গন্ধ সহ্য করে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘বিষাক্ত কালো পানির প্রভাবে ওই এলাকার মানুষ প্রায়ই নানা রকম চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হন। তাছাড়া খাল ও নদীতে মাছও পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগরতলার দূষিত পানির জন্য এই খালটি মশা, মাছি এবং অন্যান্য পোকামাকড়ের প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে তীব্র দুর্গন্ধের কারণে স্থানীয় কৃষকদের পক্ষে ধানের জমিতে কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বলেন, ‘দূষিত পানির কারণে পানিবাহিত চর্ম রোগসহ ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।’
আখাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম বলেন, ‘এই পানি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ঢাকা থেকে পরীক্ষা করে পানির সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে। পানির মান ভালো না হলেও একমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে স্থানীয় কৃষকরা ব্যবহার করে থাকেন। কৃষি বিভাগের লোকজন প্রায়ই মাঠ দিবসের মিটিংয়ে এ পানি ব্যবহার না করতে কৃষকদের অনুরোধ করেন।’
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ত্রিপুরার সঙ্গে সংযুক্ত খালের পানিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা অতিরিক্ত। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই এলাকার কৃষকরা খালে বাঁধ দিয়ে জমিতে পানি উঠায়। এ পানির সেচ জমিতে পরিমাণে বেশি দেওয়া হলে ধানগাছে পচন ধরে বলে অনেক কৃষক জানিয়েছেন।’
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসায়ী নেতারা ও সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা অনেক বছর ধরে কালো পানির সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকতে দেওয়া যায় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির পরিচালক (অপারেশনস) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের পাশের খাল দিয়ে ভারত থেকে বর্জ্য প্রবেশের বিষয়টি আলোচনায় অগ্রাধিকার পাবে। এ ধরণের বর্জ্য নিষ্কাশন বন্ধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজিবি।’
ওই খাল দিয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য প্রবাহিত হলেও এটি কেবল মানুষের ছুড়ে ফেলা বর্জ্য- এমন দাবি করে আসছে ভারত, জানালেন বিজিবির এই কর্মকর্তা।
Comments