‘স্বপ্ন দেখি মাকে পাশে বসিয়ে নিজের গাড়িতে ঘুরব’

Salma Khatun
ছবি: সংগৃহীত

লম্বা বিরতির পর পুরুষ ক্রিকেটাররা ফিরেছেন প্রশিক্ষণে। তাদের সামনে শ্রীলঙ্কা সফরের মতো একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও রয়েছে। কিন্তু নারী ক্রিকেটারদের বেলায় একই কথা বলার উপায় নেই। কারণ, করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে তাদের জন্য কোনো সিরিজের সূচি এখনও ঠিক করতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। কয়েক মাস আগে ক্রিকেটীয় কার্যক্রম বন্ধের পর থেকে দ্য ডেইলি স্টার নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলছে, তাদের পথচলা শুরুর দিনগুলোর গল্প জানার চেষ্টা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সালমা খাতুনকে নিয়ে, যিনি ২০১৫ সালে আইসিসি টি-টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ অলরাউন্ডার ছিলেন।

বাইরে থেকে দেখলে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সামগ্রিকভাবে যতটা জাঁকজমকপূর্ণ মনে হয়, প্রকৃত চিত্রটা তেমন নয়। বিশেষ করে নারী ক্রিকেটারদের আর্থিক অবস্থার বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিলেই তার প্রমাণ পাবেন। সালমা খাতুনের কথাই ধরুন। ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন সংস্করণে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অথচ এখনও একটি গাড়ি কেনা তার কাছে স্বপ্নই হয়ে আছে! গাড়ির মালিক হওয়া জাতীয় দলের তো বটেই, জাতীয় দলের বাইরের অধিকাংশ পুরুষ ক্রিকেটারের কাছে আর যা-ই হোক না কেন, ‘স্বপ্ন’ নয়। তবে সালমার মতো অনেকের কাছেই তা স্বপ্ন।

‘জীবনে অনেক স্বপ্ন পূরণ হলেও একটা স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। এখনও একটা গাড়ি কিনতে পারিনি টাকার অভাবে। গাড়ি কিনে সেই গাড়িতে মাকে নিয়ে ঘুরতে চাই। এটাই এখন আমার স্বপ্ন। যখন বাংলাদেশের অধিনায়ক হই, তখনই জেদ চাপে যে, আমি ভালো করব। আমাকে ভালো খেলতেই হবে। পরিবারের আর্থিক কষ্টের কথা মনে হয়। মা অনেক কষ্ট করেছেন আমাদের জন্য। সেসময় আমাদের একটি পাকা বাড়িও ছিল না। অনেক কষ্টে এখন একটা পাকা বাড়ি করেছি। বাড়ি করার সময় (২০০৮-০৯) সালে কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু স্যারের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম। পরে তা শোধ করে দিয়েছি। পড়াশোনা করতে পারিনি বলে মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট অনুভূত হয়। তাই আমার ভাই-বোনদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছি আর উৎসাহও দিচ্ছি,’ জানান সালমা।

‘আমাদের দেশের মেয়েদের ক্রিকেটার হতে হলে দুটি জিনিস খুব দরকার। একটা হলো পরিবারের সমর্থন, অন্যটি হল ডিসিপ্লিন (নিয়মানুবর্তিতা)।’

প্রথমটির জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সালমাকে। ক্রিকেটে পা রাখার শুরুতে নানাবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন তিনি। পরেরটিও যে তিনি সহজেই অর্জন করতে পেরেছেন, তা নয়। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে তার অধ্যবসায় ও সংকল্পের।

সালমা এমন একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, যাদেরকে জীবনের বেশিরভাগ সময় চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে। আর এ অলরাউন্ডার কখনও তা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, ‘আমার দাদার বাড়ি গোপালগঞ্জে। সেখানেই আমার জন্ম, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মা-বাবাসহ আমরা থাকতাম খুলনায় নানার বাড়িতে। আমরা চার ভাই-বোন। বাবা খুলনা শিপইয়ার্ডে একটি ছোট-খাটো চাকরি করতেন। আমার জন্মের মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে তার স্ট্রোক হয়। সেই থেকে বাবা বিছানায় পড়ে যান। টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসাও হয়নি। ২০০২ সালে বাবা মারা যান। সেসময় অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করে। অনেক সময় তিনবেলা খাবারও জুটত না। মা অনেক সময় নিজে না খেয়ে থেকে আমাদের খেতে দিতেন। এই সময় অনেক ধার-দেনা হয়। তাই আমাদের চার ভাই-বোনের কেউ আর পড়াশোনার কথা চিন্তাও করতে পারেনি।’

Salma Khatun
ছবি: সংগৃহীত

‘তখন আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, টাকার অভাবে আমরা চার ভাই-বোনের কেউ অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি।’

সালমা বলে চলেন তার সংগ্রামের দিনগুলোর গল্প, ‘২০০৭ সালে জাতীয় নারী ক্রিকেট দল গঠনের জন্য ধানমন্ডিতে একটা ক্যাম্প হয়। এরপর আমরা মালয়েশিয়াতে যাই খেলতে। ওখানে যাওয়ার পর অনেক খারাপ লাগতে শুরু করে। কারণ, আমার কোনো ফোন ছিল না। আমি কান্না শুরু করি। তিন দিন পর  আমাদের কোচের ফোন থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি। মালয়েশিয়াতে যাওয়ার সময় আমার হাতে কোনো টাকাও ছিল না। পরিবার থেকেও দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। লাগেজ কিনব কী দিয়ে, পোশাক কিনব কী দিয়ে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই। পরে আমার এক দুলাভাই আমাকে ৫ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকায় আমি মালয়েশিয়া যাই।’

সমস্ত প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সালমা ক্রিকেট খেলতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশের নারী ক্রিকেটারদের প্রথম ব্যাচের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শুরুর দিনগুলোতেই সালমা সম্ভবত তার নেতৃত্বগুণের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কারণ, যাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে বড় হয়েছিলেন, তার নিজ এলাকার সেই ছেলেরা তাকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে ডাকত।

তবে মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হিসেবে যেদিন গোটা বিশ্বের সামনে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, সেই দিনটির কথা ভেবে তিনি এখনও আতঙ্কিত হন, ‘২০০৮ সালে কোচ জাফরুল এহসান স্যার হঠাৎ আমাকে বিসিবি তে নিয়ে যান। হঠাৎ করেই আমাকে দলের অধিনায়ক বানানো হয়। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। একে তো আমি খুব একটা পড়াশোনা করিনি, তার উপর কখনও সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলিনি।’

নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণ আর জীবনের নানা জটিলতার বাঁক পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা সম্বল করে দ্রুতই ভয় কাটিয়ে ওঠেন সালমা। সেদিনই নিজের কাছে পণ করেছিলেন, ক্রিকেটার হিসেবে নাম করবেন আর পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূর করবেন। সালমা পেরেছেনও কথা রাখতে। তার অধীনে ২০১৮ সালে নারী এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেটাই ছিল নারী-পুরুষ মিলিয়ে ক্রিকেটে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা।

তৃপ্তি আর গর্ব নিয়ে সালমা বলেন, ‘২০১৮ সালে আমার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এশিয়া কাপ জিতেছিল। এটাই আমার সব চেয়ে বড় অর্জন।’

Comments

The Daily Star  | English

Hasnat calls for mass rally after Juma prayers demanding AL ban

The announcement came during an ongoing protest programme that began last night in front of Jamuna.

1h ago