‘মেয়রের আদেশ’: টিএসসি ও ধানমন্ডি থেকে কুকুর ফেলে আসা হলো মাতুয়াইলে
বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তরের বিরুদ্ধে বারবার প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর আহ্বান সত্ত্বেও শহর থেকে কুকুর সরিয়ে নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ও ধানমন্ডি এলাকা থেকে কিছু কুকুর সরিয়ে মাতুয়াইলে ফেলে রেখে আসা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তাওহিদ তানজিম করোনা মহামারিতে মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শতাধিক কুকুরকে নিয়মিত খাওয়াচ্ছেন।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘সোমবার জানতে পারি টিএসসি থেকে কুকুর নিয়ে গেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে, সিটি কর্পোরেশনের একটি গাড়ি এসেছিল, জাল দিয়ে কুকুর তুলেছে, তারপর কুকুরগুলোকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে নিয়ে গেছে। আট বা নয়টি কুকুর এখন নিখোঁজ। কিছুদিন আগেই এই কুকুরগুলোকে বন্ধ্যাকরণ ও ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।’
‘মেয়রের আদেশ’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির ভেটেরিনারি অফিসার ডা. শফিকুল ইসলাম জানান, কিছু কুকুরকে সরিয়ে এনে মাতুয়াইলে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ কুকুরগুলো সমস্যা সৃষ্টি করছিল এবং কুকুরের বিরুদ্ধে অনেকের ‘আপত্তি ছিল’।
ঢাবির ক্যাম্পাস এলাকার কুকুর নিয়ে কারো আপত্তি ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টিএসসি থেকে নয়; রমনা পার্ক থেকে কুকুর সরানো হয়েছে।’
তাকে রমনা পার্ক বন্ধের ব্যাপারে জানানোর পর সেখানকার কেউ কুকুর সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি আবারও বলেন, ‘না কেউ আপত্তি করেনি। এটি ছিল মেয়রের আদেশ।’
প্রাণী কল্যাণ আইন-২০১৯ অনুযায়ী বেওয়ারিশ প্রাণীদের স্থানান্তর অবৈধ বলে মনে করিয়ে দেওয়ার পরে, তিনি প্রথমে জানান এটি স্থানান্তর না বরং ‘সাময়িক স্থানান্তর’, কুকুরগুলো ‘ফিরে আসবে’ এবং পরে তিনি বলেন, ‘এটা মেয়রের আদেশ। তার সঙ্গেই এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে।’
মঙ্গলবার ধানমন্ডি লেক এলাকা থেকে কিছু কুকুরকেও তুলে নিয়ে মাতুয়াইলে স্থানান্তরিত করার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি।
‘কুকুরগুলো বন্ধুসুলভ, তাদেরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে’
স্টেলা অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নোনা আহমেদও ধানমন্ডি লেক থেকে একটি ট্রাকে কুকুর বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরেছন।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমি গত চার বছর ধরে এই কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছি। এই সবগুলো কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ ও টিকা দেওয়া হয়েছে। এগুলো খুব বন্ধুসুলভ কুকুর। ওরা অসুস্থ হলে আমি ওদেরকে সেবা দিয়েছি, চিকিত্সা করিয়েছি। আমি জানি ওদের সম্পর্কে কোনো অভিযোগ নেই; কারণ আমি প্রতিদিন ওদের খাওয়াই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে কুকুর নিয়ে মাতুয়াইলে রেখে দেওয়া হয়। ওটা তাদের এলাকা না। সেখানে কুকুরগুলো নিজেদের মধ্যে লড়াই করবে এবং অনাহারে মারা যাবে।’
‘একবার এই বন্ধ্যা ও টিকা দেওয়া কুকুরগুলো অপসারণ করা হলে অন্য কুকুরগুলো এলাকায় আসবে এবং সেগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।’
‘আমরা মানুষের নিরাপত্তায় কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ ও টিকা দেই। এটা নিরাপত্তার জন্য, কুকুরের জন্য না। তারা (ডিএসসিসি) কুকুরের সংখ্যা শূন্য করে ফেলতে পারেন না। আমি জানি না সিটি করপোরেশন কী চেষ্টা করছে।’
ধানমন্ডি লেক এলাকার একাধিক দোকানদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, ‘পার্কে যারা হাঁটতে আসেন তাদের সঙ্গেও বন্ধুসুলভ আচরণ করে কুকুর। কুকুরগুলো আক্রমণাত্মক বা বিপজ্জনক ছিল না।’
ডিএসসিসি যা বলছে
মঙ্গলবার মেয়র, একান্ত সচিব (উপসচিব), সহকারী একান্ত সচিব ও ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে একাধিকবার ফোনে ও এসএমএসে যোগাযোগে করা হলেও মেয়রের কাছ থেকে এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তারা প্রত্যেকেই ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি জানান, এ বিষয়ে তিনি কোনো সরকারি আদেশ সম্পর্কে জানেন না। জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএসসিসি থেকে কুকুর অপসারণের ব্যাপারে মেয়রের ‘ইচ্ছা’ নিয়ে সিদ্ধান্তের প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ছিলেন।
পরে তিনি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, তিনি এ বিষয়ে মেয়রের সাথে কথা বলেছেন। তবে খবরে যেন মন্তব্যটি তার বরাতে প্রকাশ করা হয়।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা কুকুর অপসারণ করছি, মানুষের অনুরোধকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
তিনি জানান, প্রাণী কল্যাণ আইনের যে ধারায় স্থানান্তর নিষিদ্ধ করেছে তা ব্যক্তি বা সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ অনুসারে, তৃতীয় তফসিলের ১৫.৩, ১৫.৪, ১৫.৫ ও ১৫.১০ এবং পঞ্চম তাফসিলের ৫১ ধারা ও সপ্তম তফসিলের ১৮ ধারা অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশন কুকুর স্থানান্তর করতে বা এমনকি নিধনও করতে পারে।
২০১৩ সালের হাই কোর্টের আদেশ অনুসারে দেশজুড়ে কুকুর নিধন নিষিদ্ধ।
আইন এ বিষয়ে কী বলছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট মনজিল মুর্শিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে যদি প্রাণী কল্যাণ আইন আগের আইনগুলোর তুলনায় প্রাধান্য পাবে এমন উল্লেখ থাকে (ওভাররিডিং) তাহলে আগের আইন এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। যদি এমন ধারা থাকে তাহলে সিটি কর্পোরেশনের আলাদা কোনো ক্ষমতা থাকে না।’
প্রাণী কল্যাণ আইনের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বিদ্যমান কোনো আইনে ভিন্ন যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানগুলো প্রাধান্য পাবে।
Comments