ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হোক
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর আওতায় দায়েরকৃত প্রথম মামলা জনি হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে সম্প্রতি। ২০১৩ সালে গৃহীত এ আইনের আওতায় এটাই প্রথম মামলা যার প্রত্যাশিত রায় পাওয়া গেল।
তবে দুঃখজনক হলো, এ আইনে সুস্পষ্টভাবে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও জনি হত্যা মামলার রায় পেতে তার পরিবারকে দীর্ঘ সাত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
অনেকের অভিমত, মামলাটি এ পর্যন্ত পৌঁছেছে জনির ভাই রকির অদম্য সাহসিকতা, প্রলোভনে মাথা নত না করা, ন্যায় বিচার পাওয়ার তীব্র স্পৃহার পাশাপাশি আদালতের নির্দেশে বিচারবিভাগীয় তদন্ত নিশ্চিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে এ রায় একটি মাইলফলক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে বেপরোয়া আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার সর্বোপরি হেফাজতে নির্যাতনের যে অপসংস্কৃতি চালু রয়েছে এ রায় সেক্ষেত্রে কিছুটা হলেও লাগাম টেনে ধরার কাজ করবে বলে মনে করছেন মানবাধিকার আইনজীবীরা।
এ মামলা কিংবা রায়ের তাৎপর্য তুলে ধরা আমার এ লেখার মূল বিষয়বস্তু নয়, আমি মূলত একান্ত নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করব। পত্রিকায় মামলার রায়ের খবর পড়তে গিয়ে আমি ফিরে গিয়েছিলাম ২০১৯ সালের ৩০ ও ৩১ জুলাই। মানবাধিকার সংশ্লিষ্টদের জন্য দিন দুটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এ দুদিন জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি প্রথমবারের মতো নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণবিরোধী সনদের (যা সংক্ষেপে নির্যাতনবিরোধী সনদ নামে পরিচিত) আওতায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৫-এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘কারও ওপর নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণ করা যাবে না।’ এরপর নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত সনদে এ সংক্রান্ত বিধান থাকলেও মূলত বিশ্বব্যাপী নির্যাতন বন্ধের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সুনির্দিষ্টভাবে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে এ সনদটি গ্রহণ করে, যা ১৯৮৭ সাল থেকে কার্যকর হয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এ সনদের পক্ষে বিশ্বের ১৭০টি দেশ সমর্থন দেয়।
১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ এ সনদটি স্বাক্ষর করে। তবে, সনদের ১৯ অনুচ্ছেদের প্রথম প্যারাগ্রাফ অনুযায়ী ১৯৯৯ সালের ৪ নভেম্বরের মধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করার নীতিগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর কমিটি চিঠি দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিবেদন ছাড়াও কমিটি অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ বাংলাদেশ কমিটিকে জানায়, তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদনের খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার বিধান থাকলেও প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রতিবেদনটির মূল দিকগুলো উপস্থাপন করা হয়। এ সংক্ষিপ্ত সভায় উপস্থিত নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উক্ত আলোচনা ও মূল অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছিলাম, কেননা কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে বেশি। সেই সভার সভাপতি আইনমন্ত্রীও এ মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন এবং আশ্বস্ত করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উপস্থিতি থাকবে।
ওইদিনের সভা শেষেই, মূল অধিবেশনের মাত্র দিন কয়েক আগে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদনটি কমিটির কাছে পেশ করে। অধিবেশনে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেন। নাগরিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও কয়েকজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অধিবেশনে উপস্থিত থাকার। স্পষ্ট মনে পড়ে, অধিবেশনে ১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সদস্যরা বিশেষত বাংলাদেশ সংক্রান্ত র্যাপোটিয়ার ফিলিপ গায়ার সরকার পক্ষকে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন, তথ্য জানতে চাচ্ছেন বা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন সরকারের প্রতিবেদনে বিদ্যমান আইনি, নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনাসমূহ তুলে ধরা হলেও সেগুলো বাস্তবায়নের প্রকৃত চিত্র এবং নির্যাতনের অভিযোগের বিচার সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রতিবেদনে সন্নিবেশ করা হয়নি। নির্যাতনবিরোধী সনদের আলোকে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণীত হলেও এ আইনের আওতায় ওই সময় পর্যন্ত কয়টি মামলা হয়েছে এবং কয়টি মামলার রায় হয়েছে তা জানতে চায় কমিটি। কমিটি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, তারা নাগরিক সংগঠনের প্রতিবেদন, রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদন কিংবা নিজস্ব অনুসন্ধানে কোথাও এ সংক্রান্ত তথ্য পাননি। সরকার পক্ষের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে দেখা যায় ওই মুহূর্তে তাদের কাছেও তথ্য ছিল না। আইনমন্ত্রী কমিটির কাছে সংখ্যা জানানোর জন্য সময় নেন, পরদিন তিনি কমিটিকে জানান ১৭টি মামলা হয়েছে তবে একটিরও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। কমিটি বিপুল সংখ্যক অভিযোগের বিপরীতে কেবল ১৭টি মামলা দায়ের হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে। আরও বেশি বিস্মিত হন জেনে যে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও এতদিন পরও কোনো মামলার বিচারকার্য শেষ হয়নি।
এ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এজেন্সিগুলোতে কর্মরত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। নির্যাতনবিরোধী কমিটির পর্যালোচনা চলাকালে আইনমন্ত্রী যখন কমিটির নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন এবং তার আশেপাশে থাকা অন্য প্রতিনিধিরা তাকে নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করছেন। তখন লক্ষ্য করছিলাম অধিবেশন কক্ষে আমাদের পাশে বসা সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন। তাদের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল অধিকাংশের বক্তব্যে ইঙ্গিত ছিল-গুটিকয়েক সদস্যের জন্য পুরো বাহিনীর বা বাহিনীগুলোর মর্যাদা বা ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, সরকারকে বিব্রত হতে হচ্ছে। প্রথমবারের মতো এমন অধিবেশনে অংশ নেওয়া কয়েকজন বললেন আইনমন্ত্রীর মতো তুখোড় বক্তাকেও কমিটি যেভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে, তা অকল্পনীয়। অনেকের অভিমত ছিল, সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর প্রধানসহ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আরও বেশি করে এসব অধিবেশনে অংশ নেওয়া উচিত। তাহলে তারা বুঝতে পারতেন, তাদের কর্মকাণ্ড বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কিভাবে বিদেশে নিজের দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।
অধিবেশনে অংশ নিয়ে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নানা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তারা বারবার নিজেদের বিস্ময় প্রকাশ করছিলেন আর বলছিলেন, ‘তোমাদের দেশের জন্ম হয়েছে শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে। স্বাধীনতার পরপরই তোমাদের সংবিধানে নির্যাতনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে! জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার চুক্তিতে তোমরা পক্ষরাষ্ট্র হিসেবে আছ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আছে। নির্যাতনবিরোধী সনদ স্বাক্ষর করার পাশাপাশি এ সনদের আলোকে জাতীয় পর্যায়ে আইনও প্রণয়ন করেছ, পাশাপাশি উচ্চ আদালতের এমন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আছে। তারপরেও তোমাদের দেশে নির্যাতনের এতো অভিযোগ কীভাবে ওঠে? কীভাবে এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও বিচার নিশ্চিত হয়নি?’
তারা স্বীকার করেছিলেন যে, বাংলাদেশে এ সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাদের এ বিষয়গুলো খুব ভাবিয়ে তুলেছিল। নাগরিক সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হলেও তাদের বক্তব্য ছিল- ‘অবশ্যই এ ধরনের আইন প্রয়োজন, তবে তোমাদের তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ পরীবিক্ষণ ও নিরবচ্ছিন্ন ফলো-আপের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানীকিকরণ, যাতে বিদ্যমান আইনি, নীতিগত ও বিচারিক কাঠামোর সুফল নিশ্চিত করা যায়, সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যথায়, তোমাদের যে ইতিবাচক আইন, নীতি ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে- তা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারবে না।’ এই কথাগুলো আমাদের দেশের মানবাধিকারকর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন।
কমিটি পর্যালোচনা শেষে প্রায় ৭০টির বেশি সুপারিশ প্রদান করে বাংলাদেশ সরকারকে। যার অধিকাংশেই এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত, পরীক্ষা, বিচার ও ফলো-আপের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুপারিশগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
এ পর্যালোচনায় সরকারকে তিনটি অগ্রাধিকার ইস্যুতে (হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ; আটক ব্যক্তিদের অভিযোগ তদন্তের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং যেসব এনজিও নির্যাতনবিরোধী কমিটিকে সহযোগিতা করেছে, তাদের নিরাপত্তা প্রদান) এক বছর পর প্রতিবেদন প্রদান করার জন্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি এ বছরের আগস্টে প্রদান করার কথা থাকলেও জানা গেছে তা এখন খসড়া পর্যায়ে আছে। এ প্রতিবেদনের শুরুতেই নিশ্চয় সরকার উল্লেখ করতে পারবে যে, অন্তত একটি মামলার রায় হয়েছে যেখানে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি ও জরিমানা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা, কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনি, নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আরও চার বছর পর পরবর্তী শুনানিকালে নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা হ্রাস পাবে, অভিযোগের বিপরীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মামলা দায়ের হবে এবং বিচার সম্পন্ন হবে।
তামান্না হক রীতি: আইন ও সালিশ কেন্দ্র
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments