তিস্তাপাড়ে বাস্তুহারা মানুষের আহাজারি
তিস্তাপাড়ের এক কৃষক আজিজুল ইসলাম (৬৫)। গত এক সপ্তাহে তার ছয় বিঘা আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব, ভূমিহীন।
নদীপাড়ে বসে শুধুই কাঁদছেন আজিজুল। এছাড়া তার আর কিছু করার নেই। কোনো রকমে তিনটি ঘর রক্ষা করে স্থানীয়দের সহায়তায় উঠেছেন সরকারি রাস্তার উপর। সাত জনের সংসার নিয়ে চরম দারিদ্রতা আর কষ্টের মাঝে ডুবে গেছেন এই কৃষক।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের চৌরাহা গ্রামের কৃষক আজিজুল জানান, দেখতে দেখতে তিস্তার গর্ভে চলে গেছে তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন আবাদি জমি ও স্বপ্নের বসতভিটা। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখন চরম দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। ‘চোখে ঘুম নেই, পেটে ভাত নেই। শুধুই স্মৃতি তাড়া করে।’
একই ইউনিয়নের রজবটারী গ্রামের খোদেজা বেওয়া (৬৭) জানান, তার একমাত্র সম্বল আট শতাংশ জমির বসতভিটা চলে গেছে তিস্তার উদরে। দুটি ঘরের একটি ঘরও বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়দের সহায়তা নিয়ে একটি ঘর বাঁচাতে পেরেছেন, আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের জমিতে। ‘এর আগে তিস্তা আমাদের ১৫ বিঘা জমি গিলে খেয়েছে। সর্বশেষ বসতভিটাটুকুও চলে গেল। এখন আমি নিঃস্ব, ভূমিহীন, বাস্তুহীন।’
একই ইউনিয়নের গোবর্ধান গ্রামের কৃষক নুর ইসলাম (৭০) জানান, শুধু কান্না ছাড়া আর কিছুই রইল না। আবাদি জমি, ফলের বাগান ও বসতভিটা চলে গেছে তিস্তা গর্ভে। ঘরগুলো ভেঙ্গে সরকারি রাস্তার উপর টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। ‘তিস্তা আমাদেরকে গরীব আর অসহায় করে দিলো।’
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ইউনিয়নের মধুরাম গ্রামে তিস্তাপাড়ে কৃষক মনিন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৪) বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে আমার তিন বিঘা জমি আর বসতভিটা তিস্তায় বিলীন হয়ে গেছে। জমিতে কষ্ট করে ধান লাগিয়েছিলাম। এখন জমিও নেই, বসতভিটাও নেই। পরিবার নিয়ে উঠেছি সরকারি রাস্তায়। জীবনে আর কোনোদিন আবাদি জমি আর বসতভিটা করতে পারবো না। এখন ভূমিহীন মানুষের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে হবে।’
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, লালমনিরহাটে তিস্তাপাড়ের গোকুন্ডা, রাজপুর, খুনিয়াগাছ, মহিষখোঁচা, ভোটমারী, গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ী ও দহগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে এসব গ্রামে দেড় হাজারের বেশি বসতভিটা ও তিন হাজার বিঘার বেশি আবাদি জমি তিস্তার গর্ভে চলে গেছে। এসব গ্রামে তিস্তার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইউনিয়নে তিস্তাপাড়ের ছয়টি গ্রামে এখন শুধু কান্না আর আহাজারি। বসতভিটা হারিয়ে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে সরকারি রাস্তা, বাঁধ, অন্যের জমি বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। এখনও চলছে তিস্তা নদীর ভাঙন।’
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিস্তাপাড়ে ভাঙনকবলিত কয়েকটি স্থানে জিও-ব্যাগে বালুভরে ডাম্পিং করা হচ্ছে ভাঙন ঠেকানোর জন্য। ভাঙন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে বালু ভর্তি জিও-ব্যাগও কাজে আসছে না। তিস্তার ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
Comments