ভারতের নতুন কৃষি আইন ‘কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা’
কৃষিখাত সংস্কারে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন তিনটি কৃষি বিলকে ‘কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা’ বলে আখ্যায়িত করেছে ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস। তবে এই বিল দেশটির কৃষিখাতকে উন্নয়নের জন্য বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
রাজ্যসভায় কংগ্রেসের সংসদ সদস্য প্রতাপ সিং বাজোয়া বলেন, ‘কৃষকদের জন্য মৃত্যু পরোয়ানায় সই করবে না কংগ্রেস।’
রাজ্যসভায় এ সংক্রান্ত বিল পাশ হওয়ার পর গতকাল রোববার এতে সই করেন দেশটির রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। ফলে বিলটি আইনে রূপান্তরিত হয়েছে।
এই আইন নিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পরেছে দেশটির রাজপথেও।
ক্ষুব্ধ এবং উদ্বিগ্ন কৃষকরা এই আইনকে অন্যায্য এবং শোষণের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। সংস্কারপন্থী অর্থনীতিবিদরা এই আইনকে আংশিকভাবে স্বাগত জানালেও, তাদের মতে এটি খুব বেশি কাজে আসবে না।
নতুন প্রস্তাব
এই আইনের মাধ্যমে কৃষিপণ্য বিক্রয়, মূল্য নির্ধারণ ও গুদামজাত করণের নিয়মে পরিবর্তন আসবে। যে নিয়ম ভারতের কৃষকদের গত কয়েক দশক ধরে মুক্ত বাজার থেকে রক্ষা করেছে।
কৃষকরা চাইলে যে কারও কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবে। আগে যা কেবলমাত্র সরকার অনুমোদিত এজেন্টদের কাছেই বিক্রি করতে হতো।
বড় পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কৃষকরা তাদের পণ্য বাজার মূল্যে কৃষি ব্যবসায়ী, সুপারমার্কেট চেইন এবং অনলাইন ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার অনুমতি পাবে।
বর্তমানে বেশিরভাগ ভারতীয় কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত পাইকারি বাজারে নির্ধারিত দামে বিক্রি করে থাকেন।
এই বাজারগুলো কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সাধারণত এসব কমিটিতে বেশি জমির মালিক ও ব্যবসায়ী বা ‘কমিশন এজেন্ট’রা থাকেন। এই এজেন্টরা পণ্য গুদামজাত, অর্থায়ন এবং পরিবহনের দায়িত্বে থাকে।
নতুন কৃষি আইনের মাধ্যমে কৃষকরা চাইলেই তাদের পণ্য সরাসরি নিজেরাই নিজেদের পছন্দমত ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
সমস্যা
এ পর্যন্ত বিষয়টি দেখতে কৃষকদের জন্য খুবই ভালো বলে মনে হলেও, কৃষকদের ভয় এই পদ্ধতির ফলে তাদের বর্তমান পাইকারি বাজার বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং সরকার নির্ধারিত দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বর্তমানে দেশটির অনেক রাজ্যে পাইকারি বাজারে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি নিজের পছন্দের বিক্রেতার কাছেও পণ্য বিক্রির সুযোগ রয়েছে। তবে, নতুন আইনের কারণে তাদের ক্রেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে মনে করেন কৃষকরা। সেক্ষেত্রে তাদের সরকার নির্ধারিত দাম পাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকবে না।
পাঞ্জাবের এক কৃষক বিবিসিকে বলেন, ‘প্রথম দিকে কৃষকরা এই বেসরকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ভালো দামে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি পাইকারি বাজার বন্ধ হয়ে যাবে এবং সেই সুযোগে এই ব্যবসায়ীরা কৃষকদের শোষণ করা শুরু করবে। এটাই আমদের ভয়।’
দেশটির সরকার দাবি করছে যে, প্রচলিত পাইকারি বাজার বন্ধ হবে না এবং ন্যূনতম মূল্যের ব্যাপারে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। তবে এই আশ্বাসের ব্যাপারে সন্দিহান কৃষকরা।
এটি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ওঠার কারণ
কৃষকরা রাজনৈতিক দলগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাংক। সেই সঙ্গে চলমান এই বিতর্ক দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভক্ত করেছে।
রাজ্যসভায় এই বিলটি নিয়ে আরও আলোচনা করতে কিংবা একটি বিশেষ কমিটি করে এই বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত জানতে বিরোধীদল বার বার চাপ দিলেও, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাতে রাজি হয়নি। এতে করে বিলটি নিয়ে সংসদেও ছড়িয়েছে উত্তাপ।
কণ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সংসদে বিলটি পাশ হয়। তবে বিরোধী দলের দাবি, সংসদে চলমান উত্তাপের মধ্যে এই বিলটি পাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট এসেছে কি না, তা বোঝা সম্ভব ছিল না।
এর সহজ সমাধান নেই
ভারতের এই কৃষি আইন এক বাক্যে ভালো বা মন্দ বলার মতো পরিস্থিতি নেই। এর পেছনে স্বল্প উৎপাদনশীলতা, জমি ভাগ হতে থাকা, গুদামজাত করণের জন্য অবকাঠামোর অভাব এবং কৃষকদের উচ্চ ঋণগ্রস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে।
ভারতের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণেই এই খাতে সংস্কার খুবই প্রয়োজন। তবে নতুন এবং বিতর্কিত এই সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকদের সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সরকারের লক্ষ্য, এর মাধ্যমে কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলা। এই আইনের মাধ্যমে কৃষকদের ওপর থেকে মধ্যসত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে চায় সরকার। তবে এই পরিবর্তনের ফলে তারা তাদের কমিশন হারাবে এবং রাজ্য সরকারের রাজস্ব সংগ্রহেও পরবে এর প্রভাব।
বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, কৃষিখাতে এমন পরিবর্তনের ফলে উন্নতির বিপরীতে প্রায়শই কৃষকদের আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কৃষি নীতি বিশেষজ্ঞ দেবেন্দ্র শর্মা বলেন, ‘কৃষকদের এভাবে মুক্ত বাজারে ছেড়ে দেওয়া আর নেকড়ের সামনে ভেড়া রেখে দেওয়া একই কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থায় সমস্যা রয়েছে এবং এর সংস্কার দরকার। তবে একটি ব্যর্থ মডেলের মাধ্যমে আগের পদ্ধতি বদলে ফেলা কোনো সমাধান নয়।’
Comments