এইচএসসি পরীক্ষা: আর কোনো বিকল্প ছিল না?
সিদ্ধান্তটি যে খুব আকস্মিকভাবে এসেছে, তা নয়। এইচএসসি পরীক্ষা হবে কি হবে না, বিষয়টি আলোচনায় ছিল। সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ৭ অক্টোবর ঘোষণা দিলেন, করোনা মহামারির কারণে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হবে না। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। ১৩ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করবে, তাও জানা গেছে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘অবশ্যই সবাই পাস করবে। তবে, ফলটা কী হবে সেটা নির্ভর করছে তার জেএসসি ও এসএসসির পরীক্ষার ফলাফলের ওপর।’ (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০২০)।
উল্লেখ্য ১৯৭২ সালে পরীক্ষা না নিয়ে পাস করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তা হয়তো অনিবার্য ছিল। অনেকেই বলছেন, করোনা মহামারিও এক ধরনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধকালে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। কোনো সন্দেহ নেই যে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে সবচেয়ে উন্নত দেশসহ পৃথিবী প্রায় বিধ্বস্ত। আবার সংকট কাটিয়ে পৃথিবী স্বাভাবিক অবস্থায়ও ফিরছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে বাংলাদেশও।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন এসেছে, পরীক্ষা না নেওয়াটা অনিবার্য ছিল কি না? আর কোনো বিকল্প ভাবার সুযোগ ছিল কি না? আরও কয়েক মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার মতো সময় হাতে ছিল কি না? পরীক্ষা হবে না, দেশের শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না?
নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে জোর দিয়ে বারবার বলা হচ্ছে, সরকার অত্যন্ত কার্যকরভাবে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করেছে। একথা সত্যি যে, করোনাভাইরাস বাংলাদেশে অত্যন্ত কম প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে প্রাণহানি বিবেচনায়। ইউরোপ, আমেরিকা তো বটেই, ভারতের তুলনায়ও অনেক কম মানুষ মারা গেছে বাংলাদেশে। পরীক্ষা কম হওয়ায় আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা হয়তো জানা যায়নি। কিন্তু, মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকায় সমাজ জীবনে তা প্রভাব ফেলেনি। বাংলাদেশে এখন সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা এখনো সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলেও সরকার বা জনমনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। অফিস-আদালত, রাস্তা-বাজার, গণপরিবহন— সর্বত্রই পূর্বের সেই ভিড় ফিরে এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘সকল জল্পনা-কল্পনা ঠেকিয়েই কোভিডে এখন নিরাপদ বাংলাদেশ‘। (দ্য ডেইলি স্টার, ৪ অক্টোবর ২০২০)।
বাংলাদেশ যদি ‘নিরাপদ’ হয়, তবে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে তো সমস্যা থাকার কথা নয়। তাহলে সরকারের নিজেরই কি ‘নিরাপদ’ ভাষ্যে বিশ্বাস নেই?
শিক্ষা তো শুধু শিক্ষামন্ত্রী, আমলা বা মন্ত্রণালয়ের বা রাজনীতির বিষয় নয়। শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষাবিদদের বিষয় শিক্ষা। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে, সেখানেও মেডিকেল শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা আছেন। এইচএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এসব বিশেষজ্ঞদের মতামত বা পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, এমন তথ্য জানা যায় না। কমিটির দুই জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না।
দেশের স্বীকৃত শিক্ষাবিদ হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের নিয়ে কোনো কমিটি করার তথ্য জানা যায়নি। জানা যায়নি তাদের মতামত বা পরামর্শ নেওয়ার বিষয়টিও। কারিগরি কমিটির বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল। যা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ভারতের উদাহরণ কিছুটা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ভারতে এইচএসসি লেভেলের পরীক্ষা চলছিল গত মার্চে। পরীক্ষা চলাকালীনই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য বিভাগের পরীক্ষা কিছু হয়েছিল, কিছু হয়নি। পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। যে পরীক্ষাগুলো হয়েছিল তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে ফল প্রকাশ করা হয়। সমস্যা জটিল হয় মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়।
কলকাতার সাংবাদিক প্রতীম রঞ্জন বসু আজ ৮ অক্টোবর সকালে দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভারতে মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে সকল রকমের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। অনলাইনে নয়, শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে গিয়েই পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অনেকেই এর বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছিলেন। আদালত রায় দিয়েছিলেন পরীক্ষার পক্ষে। এখন অনলাইনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছে। যেহেতু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিস্তৃত এলাকার কলেজগুলো সম্পৃক্ত, ফলে সরাসরি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে এ-লেভেল এবং ও-লেভেলের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে চায়নি। আদালতেও গিয়েছিল আর্জি নিয়ে। আদালত রায় দিলেন পরীক্ষার পক্ষে। সেই পরীক্ষা চলছে। সংখ্যা বিবেচনায় এ-লেভেল এবং ও-লেভেলের সঙ্গে এইচএসসির কোনো তুলনা চলে না।
তুলনা না চললেও, বিকল্প ভাবার কোনো সুযোগ ছিল না— তা বলা যায় না। সব বিষয়ের পরীক্ষা না নিয়ে চারটি বা অন্তত দুটি বিষয়ের পরীক্ষা নিয়েও মূল্যায়ন করা যেত কি না, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের মতামত নিলে হয়তো বিষয়টি বিবেচনায় আসতে পারতো। যা করা হয়নি।
যে যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় করাটা অপরিহার্য মনে করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘একটি বা দুটি প্রশ্নের ভিত্তিতে অল্প সময়ের পরীক্ষার বিষয়টি ভাবা যেতে পারত। সব বিষয় নয়, দু-তিনটি বিষয়ের পরীক্ষার কথা ভাবার সুযোগ ছিল। আরও অপেক্ষা করার মতো সময় ছিল কি না, সেটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। সবাইকে পাস করিয়ে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির ক্ষেত্রে কী করবে, তা ভাবা দরকার ছিল।’
‘জেএসসিতে যারা ভালো করে, এসএসসিতে তাদের কত শতাংশ কেমন করে বা এসএসসি পাস করে কত শতাংশ এইচএসসিতে কেমন করে, এসব মূল্যায়ন করা অসম্ভব নয়। তা না হলে সরলভাবে জেএসসি আর এসএসসি মেলালে বড় ভুল হবে।’
আরও দুই-তিন মাস অপেক্ষা করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সুযোগ ছিল কি না, তাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়নি।
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ যদি তীব্র না হয়, শীতে যদি পরিস্থিতির অবনতি না হয় বা কম মাত্রায় অবনতি হয়, আগামী বছরের মার্চে পরীক্ষা নেওয়া অসম্ভব নাও হতে পারতো।
যদিও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, ‘আরও দুই-তিন মাস আগে থেকে আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল না। আমরা ১০ বা ২০ সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারতাম। একেক বিভাগের পরীক্ষা চার ধাপে হতে পারত। পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা কম হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া যেত। বেশ কিছু বিকল্প ছিল। এর জন্যে চিন্তা-ভাবনার দরকার ছিল।’
‘আজই সেসব বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা দরকার, যারা মাঠ পর্যায়ের এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমি কলেজের শিক্ষকদের কথা বলছি। তারা এ বিষয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। পরীক্ষা না নিয়ে এভাবে সবাইকে পাস করালে সামনে অনেকগুলো সমস্যার মুখে পড়তে হবে’, বলছিলেন মনজুরুল ইসলাম।
তিনি বলছিলেন, ‘সাধারণত জেএসসিতে নম্বর বেশি পায়। এসএসসিতে একটু কমলেও এইচএসসির তুলনায় বেশি নম্বর পেয়ে থাকে। এইচএসসির মূল্যায়নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিএসসি বা চাকরির অন্যান্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে এদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে? যদি ভাবা হয় এরা পরীক্ষা ছাড়া পাস করে এসেছে, সুতরাং...। মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশেষায়িত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নম্বরের গড় নিয়ে একটা সমস্যায় পড়তে হবে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা তো নিতেই হবে।’
এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়ার বিষয়টিকে শিক্ষাবিদ যতীন সরকার আত্মঘাতী বলেছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আত্মঘাতী বলব না। বলব, জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পাস করানো যায় না। এটা করানো উচিত নয়। বিকল্প পথ আছে এবং এখনই তা ভাবা দরকার।’
জেএসসি পরীক্ষার মান এবং মূল্যায়ন নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন আছে। গত বছর এইচএসসি পরীক্ষায় গড়ে অকৃতকার্য হয়েছিল ২৬ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি বছর এইচএসসিতে গড়ে ২৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। এই ২৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীদের সবাই কিন্তু এসএসসিতে কৃতকার্য হয়েছিল। তার মানে দাঁড়াল, যে ২৫ শতাংশ এবার ফেল করত, তাদেরকেও পাস করিয়ে দেওয়া হবে। গত বছর ফেল করা সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে এক থেকে দেড় লাখের এবার আবার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তারাও পরীক্ষা না দিয়ে পাস করবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ইস্যুতে এমনিতেই গত ১০ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, মেডিকেলে ভর্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ব্যাংকের চাকরি, সব ক্ষেত্রের প্রশ্নপত্র নিয়ম করে ফাঁস হয়েছে। ‘অস্বীকারে’ নুরুল ইসলাম নাহিদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়িত্ব শেষ করেছে। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার মতো অকাঠ্য প্রমাণও তাদের ‘অস্বীকার’ প্রবণতা থেকে টলাতে পারেনি। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে। পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়েছে, আর তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম শুধু ‘অস্বীকার’ করেছেন। এখন সিআইডির অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। নিয়ম করে ফাঁস হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার একাধিক ইউনিটের প্রশ্নপত্র একাধিকবার ফাঁস হয়েছে।
হেফাজতের দাবি অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করেও শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকরণ হয়েছে। এ অভিযোগ সরকারপন্থি অনেক শিক্ষাবিদেরও। মৌখিক নির্দেশে ফেল করা স্কুল শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তো ছিলই।
সেসব ধাক্কা কাটতে না কাটতেই করোনাভাইরাস মহামারিতে আক্রান্ত হলো এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? মূল্যায়ন করবেন কে, কারা? রাজনীতিবিদ আর আমলাতন্ত্র? শিক্ষাবিদদের অংশগ্রহণ বা পরামর্শ বা নির্দেশনার প্রয়োজন আছে বলে মনেই করব না?
Comments