প্রবাসে

বিলেতযাত্রা

যুক্তরাজ্যের রিডিং শহর। ছবি: লেখক

গত ৩ অক্টোবর সকাল ৬ টা বেজে ৩৫ মিনিট। ঢাকা থেকে আমার প্লেন রানওয়েতে তুমুল বেগে ছুটে চলেছে। বেশ খানিকটা উত্তেজিত আমি। আবার ভয়ও পাচ্ছি। এর আগে কোনোদিন বিমানে উঠি নাই। এই প্রথম। অনেক কিছু ভাবছি, কী হবে প্লেনটা ভালোভাবে ফ্লাই না করতে পারলে? যদি রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে? টেক অফ করার সময় কি অনেক বেশি ভয় লাগবে? যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি? কত চিন্তা!

কিন্তু না, কী সুন্দর করে প্লেনটা আকাশে উঠে গেল। ৬ টা ৪২ তখন। হঠাৎ বুকটা শূন্য হয়ে গেল। প্লেনের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ঢাকা শহরের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। আমার শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে। শুরু হলো আমার বিলেতযাত্রা।

এ বছর বাংলাদেশ থেকে যে ১২ জন পেশাজীবী শেভেনিং স্কলারশিপ পেয়েছেন আমি তাদেরই একজন। আবেদন করেছিলাম গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর প্রায় দশ মাস অপেক্ষা করে চূড়ান্ত ফল পাই এই বছরের জুন মাসে। তারপর শুরু হলো বিলেতে যাওয়ার প্রস্তুতি। এর মাঝে করোনার জন্য অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু যে শিক্ষাটা পেলাম সেটা হলো, নানা কিছু নিয়ে অযথা দুশিন্তা করার কোনো মানে হয় না।

ঢাকায় ফ্লাই করার আগে এয়ারপোর্টে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই আশেপাশে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমাদের সাথে ইমিগ্রেশন করেছে এমন এক যুবককে পুলিশ পাহারা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। স্যুট টাই পড়া স্মার্ট যুবক। একটু এগিয়ে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের ঘটনা জিজ্ঞাসা করলাম। উনারা বললেন, এই ছেলে নাকি মানবপাচারের শিকার! আমি জিজ্ঞাসা করলাম কীভাবে? উনারা বলল, ছেলেটা নাকি তুরস্কে যাবে কোনো একটা কনফারেন্সে জয়েন করার জন্য। কিন্তু উনার কাছে কোনো আমন্ত্রণপত্র নেই। কোন কনফারেন্সে যাবে সেটার নামও নাকি বলতে পারে না।

আরও জানতে পারলাম কোন একটা এজেন্সি নাকি ছেলেটাকে তুরস্কের ভিসা করে দিয়েছে। তুরস্ক হয়ে ছেলেটা ইউরোপে পাড়ি জমানোর কথা। দেশে থাকতে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে কাজ করতাম মানবপাচারের বিরুদ্ধে। কাজেই আগ্রহ হলো। সেখানে দাঁড়িয়ে ছেলেটার ছোটখাটো একটা সাক্ষাৎকার নিলাম। অনেক কিছু জানতে পারলাম। প্রায় প্রতি দিনই নাকি চার পাঁচজন করে এভাবে ধরা পড়ে।

আমার ট্রানজিট ছিল তুরস্কের ইস্তানবুলে। প্লেন থেকে নামার পর লন্ডনের প্লেন ধরার জন্য হাতে মাত্র আড়াই ঘণ্টা  সময়। ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট অনেক বড়। এলাহি কারবার বলতে গেলে। প্লেন থেকে নেমেই দিলাম দৌড়। এর আগে যে টানা ভ্রমণ করে এসেছি, সারারাত ঘুমাইনি সেই ক্লান্তির কোনো ছাপ আমার চোখে মুখে নেই। শাহ জালাল এয়ারপোর্টে করোনার কারণে তেমন একটা ভীড় নেই। কিন্তু এখানে যাত্রীদের প্রচন্ড চাপ। আমি প্লেন থেকে নামার আগেই মাস্ক পরে নিলাম। কেউ যদি আমাকে মাস্ক পরা না দেখে যদি কিছু বলে বসে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো।

ইস্তানবুলে দেখলাম অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজব ব্যাপার, কারো এ ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সবাই মনে হয় মাস্ক পরতে পরতে বিরক্ত হয়ে গেছে। এরমধ্যে দুই বাঙালি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। হাঁটতে হাঁটতে তাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তারা কোন শহরে থাকে, কী পড়ে ইত্যাদি। কথার মধ্যে খোলাসা করে বলেই ফেললাম, ভাই আমি জীবনে প্রথম ফ্লাই করেছি, প্ল্যাটফর্ম চিনি না, একটু হেল্প করবেন? তারা কিছুই বলল না। একটু পরে দেখি আমার সামনে থেকে উধাও হয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। প্রায় ৪০ মিনিট হাঁটার পর কেন যেন মনে হল ভুল পথে হাটছি, এরপর একজনকে আমার প্ল্যাটফর্মের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, উনি যা বলল সেটা শোনার পরে রীতিমত আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হলো। আমি নাকি আমার প্ল্যাটফর্ম অনেক পেছনে ফেলে রেখে এসেছি। কী ঝামেলা! এরমধ্যে লক্ষ্য করলাম, উত্তেজনায় জ্যাকেট পরা অবস্থায়ই ঘামা শুরু করেছি। কী আর করা, জ্যাকেট খুলে দিলাম আবার দৌড়। এরপর প্রায় দশ জনকে আমার প্ল্যাটফর্মের কথা জিজ্ঞাসা করেছি। সবাই সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। মাত্র ১৫ মিনিট আগে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছালাম। দুই জন ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে জিজ্ঞসাবাদ করবে। ওনাদের মুখেও মাস্ক নেই, কিন্তু আমার মুখে আছে। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে প্রশ্ন করা শুরু করল। ইউকেতে কেন যাচ্ছি? কোন ইউনিভার্সিটিতে, কী পড়তে যাচ্ছি, সেখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা, এর আগে কোন কোন দেশে ভ্রমণ করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্নগুলো শুনে আমার বারবার শাহজালাল এয়ারপোর্টের কথা মনে হচ্ছিল। এভাবেই হয়তো আমার দেশের অনেক যুবক অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে চায় যার কারণে তুরস্কের পুলিশ বাংলাদেশিদের একটু সন্দেহের চোখেই দেখে।

যাই হোক আমার সব উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন তারা। এরপর বিমানে উঠলাম, সরাসরি লন্ডনে নামবো। বিমানের ভেতরে যারা আছেন তারা সবাই লন্ডন যাবেন কিন্তু অধিকাংশ যাত্রী মাস্ক ছাড়া। বিমানবালা বার বার এসে মাস্ক পরার ব্যাপারে সতর্ক করে যাচ্ছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা!

লন্ডনে যখন নামলাম তখন যুক্তরাজ্য সময় ৪টা বেজে ২০ মিনিট। আমাকে নিতে এসেছেন তানভির ভাই যিনি লন্ডনে বার-এট-ল পড়ছেন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। আবেগে নিয়ম কানুন ভেঙে আগে কোলাকুলি করে নিলাম। এরপর সরাসরি চলে গেলাম এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রো ধরার জন্য। আমাদের গন্তব্য গ্রিন পার্ক হয়ে লন্ডন ব্রিজ আর ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাাবে। লন্ডনে এসেছি কিন্তু এই দুটি জিনিস দেখব না তাতো হয় না। আমার শরীরে তখনও কোনো ক্লান্তি নেই। তানভির ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই আমি ৩০ ঘণ্টা ধরে জার্নি করেছি আমার কোন ক্লান্তি নেই কেন? ভাইয়ের সোজাসাপ্টা উত্তর: উত্তেজনায়। আমিও মেনে নিলাম। 

লন্ডনের মেট্রো স্টেশনে গিয়ে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এ তো বিশাল যজ্ঞ! আন্ডারগ্রাউন্ডটা মোটামুটি চার-পাঁচ তলা বিল্ডিং এর সমান হবে। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা নাকি এই স্টেশনগুলোতে আশ্রয় নিত। তবে ব্রিটিশ মেট্রো স্টেশন পুরোপুরিভাবে চেনার জন্য অনেক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। আমার কাছে খুব ঝামেলার আর প্যাঁচানো মনে হয়েছে। একা থাকলে নির্ঘাত হারিয়ে যেতাম। সেই দিনের জন্য এখনো তানভির ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা মেট্রোতে করে সরাসরি লন্ডন ব্রিজে চলে গেলাম। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!

এখানেও একই চিত্র কেউ মাস্ক পরে না। ব্রিজের উপর দিয়ে যতজন হেঁটে গেল সবাইকে লক্ষ্য করলাম। একজনকেও মাস্ক পরা অবস্থায় দেখিনি। আমি ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে আছি, পাশে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে, তার নিচে টেমস নদী বয়ে যাচ্ছে, একটু দূরে ওয়েস্টমিনস্টার এলাকার পার্লামেন্টের উত্তরাংশে ক্লক টাওয়ার। অপূর্ব দৃশ্য!

রাত সাড়ে নয়টায় আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমাদের টিইট আগেই বুকিং দেয়া ছিল। এরপরের গন্তব্য তানভির ভাইয়ের বাসা, বার্মিংহ্যাম। আমি বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশাল পলিসিতে মাস্টার্স করার জন্য ডাক পেয়েছিলাম, কিন্তু আমার তো ইচ্ছা পাবলিক পলিসিতে পড়ার। তাই ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং এর অফারটা নিই। কিন্তু আপাতত রিডিং শহরে থাকার কোনো জায়গার ব্যবস্থা হয়নি, তাই তানভির ভাইয়ের সাথে তার বার্মিংহ্যাম এর বাসায় যাচ্ছি। সেখানেই থাকব কিছুদিন।

বার্মিংহ্যাম নেমে দেখলাম গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। উবার কল করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। উবারে উঠতে উঠতে গা খানিকটা ভিজে গেল। প্রচন্ড শীত। কাপতে কাপতে বাসায় এসে যখন পৌঁছলাম তখন রাত ১২ টা ১০। প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে। বাংলাদেশে যখন থাকতাম তখন প্রায় সপ্তাহেই গ্রামের বাড়ি মার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। মা অনেক কিছু রান্না করে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে রাখতেন। আমি গিয়েই হাত মুখ ধুয়েই খাওয়া শুরু করতাম। সব কিছু কেমন যেন অমৃতের মতো লাগত। বাসায় ঢুকেই সে কথা মনে পড়ে গেল। আমি এখন আমার মায়ের কাছ থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে। মা হয়তো ভাবছে আমারই কথা। মা তোমার রান্না করা খাবারের স্বাদ এখান থেকে না পেলেও ঘ্রানটা ঠিকই পাই। দোয়া করো আমার জন্য মা।  

(লেখক: শোয়াইব মোহাম্মদ সালমান, মাস্টার্স শিক্ষার্থী, পাবলিক পলিসি, ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং, ইউকে)

Comments

The Daily Star  | English

Ishraque announces suspension of protest for 48 hours

He made the announcement while talking to the party men in front of Kakrail mosque this afternoon

15m ago