সিলেটে রায়হান হত্যায় নাগরিক প্রতিক্রিয়া

‘পুলিশ মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না’

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত রোববার এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় ওই ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিদর্শকসহ চার পুলিশকে বরখাস্ত এবং আরও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে গতকাল সোমবার।
রায়হান আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত রোববার এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় ওই ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিদর্শকসহ চার পুলিশকে বরখাস্ত এবং আরও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে গতকাল সোমবার।

টাকার জন্য পুলিশ ফাঁড়িতেই তাকে গুরুতর নির্যাতন করার পর হাসপাতালে মারা যাওয়ার এ ঘটনায় পরিবার ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে রোববার দিনগত রাতে মামলা করলেও এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

এ ঘটনাটিকে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে ছিনতাইকারীর মৃত্যু হিসেবে সাজানোর চেষ্টা বানচাল হয়ে যাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ ফাঁড়ির সংশ্লিষ্টদের ‘গাফিলতি’ পাওয়ায় তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মৃত্যুর বিষয়ে পরিবারের অভিযোগ জানার পর মামলা দেওয়ার আগেই পুলিশ অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করে কাজ শুরু করে। এতে ওই ফাঁড়িতে কর্মরতদের দায়িত্বে গাফিলতি পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি অপরাধী হলেও তার মানবাধিকারের বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু, ওই রাতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে এসব লঙ্ঘিত হয়েছে। আর তাই দায়িত্বরতদের গাফিলতির জন্য চার জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।’

ফাঁড়িতে নির্যাতন বা এর সঙ্গে জড়িত কারা, এসব বিষয়ে পরিবারের দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খতিয়ে দেখবেন বলেও জানান উপ-কমিশনার।

তবে, সিলেটে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনদের মন্তব্য, প্রচলিত তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রকৃত সত্য উঠে আসবে না এবং ভুক্তভোগীর পরিবারও বিচার পাবে না। তাদের দাবি, বিষয়টির উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাশীল তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জায়েদা শারমিন স্বাতী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলো যে বার্তা দেয়, তা সুখকর না। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণের আগেই নির্যাতন বা মেরে ফেলা, এটা স্বাভাবিক কোনো বিষয় না। গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো নাগরিকের সঙ্গে এরকম আচরণ করা যায় না।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে পুলিশই মানুষের আশ্রয়স্থল। কিন্তু, আমাদের দেশে বিষয়টি ভিন্ন। ইদানীং পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি কিছুটা ভালো হলেও সাধারণ জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারছে না।’

‘সম্প্রতি মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড বা এরকম যত ঘটনা, তাতে মানুষ পুলিশদের নিয়ে আতঙ্কিত। এই আতঙ্কটা কাটাতে পুলিশ বাহিনীকে যেমন তাদের এখতিয়ার জানতে হবে, তেমনি জনগণকেও জানাতে হবে পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতা আইনগতভাবে কতটুকু’, বলেন তিনি।

এ ধরনের ঘটনায় প্রায়ই পুলিশ সদস্যদের অপরাধ ঢাকতে এবং তাদের বাঁচাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিপরীতমুখী অবস্থান দেখা যায়, যা কাম্য নয় বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. জায়েদা শারমিন স্বাতী।

সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পুলিশ যেভাবে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করে, তাতে মনে হয় তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। আর দুর্নীতির সঙ্গে পুলিশের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কারণে সুনামের চেয়ে দুর্নামের পরিমাণ এখন বেশি।’

তিনি বলেন, ‘বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যুবককে নির্যাতন করে হত্যার বিষয়টা বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই একটা অংশ। আর এ ধরনের অপরাধের পরও অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত বা বদলির মধ্যেই শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকে। এই যুবকের মৃত্যুর পর সত্যটা প্রকাশ পেয়েছে। যাতে বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে, কিন্তু, জনসমক্ষে আসে না। এসব বন্ধ করতেই হবে।’

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত নতুন যে আইন— ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩’, আছে, সে অনুযায়ী এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটলে এর দায় সম্পূর্ণ তাদের।’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীর দায়িত্ব যখন জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তখন তাদের হেফাজতেই মানুষ মারা যাচ্ছে এবং অভিযোগ আসছে তাদের নির্যাতনেই মৃত্যু হচ্ছে। এসব বিষয় সাধারণ তদন্তে হবে না। বরং প্রয়োজন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা। যাতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে।’

এ হত্যাকাণ্ডে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

সোমবার রাতে নিহত রায়হানের পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরে এক বিবৃতিতে তিনি পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাশুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনও সোমবার রাতে রায়হানের পরিবারের পাশে গিয়ে তারা সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।

গত রোববার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে সিলেট নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক যুবককে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৭টা ৫০ মিনিটে তার মৃত্যু ঘটে।

নিহত রায়হান আহমেদ (৩৩) নগরীর নেহারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

প্রাথমিকভাবে স্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যমে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হলেও পরবর্তীতে পুলিশ তাদের বক্তব্য পরিবর্তন করে।

এ ঘটনায় রোববার দিনগত রাতে সিলেটের কোতোয়ালী থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, সেদিন বিকেলে ডাক্তারের চেম্বারের কম্পাউন্ডার হিসেবে কর্মরত তার স্বামী কাজে বের হয়ে যাওয়ার পর রাত ১০টা থেকে তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। রাত ৪টা ৩৩ মিনিটে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে রায়হান তার মাকে কল করে কথা বলেন।

ওই কলে রায়হান কাঁদতে কাঁদতে জানান যে তাকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রেখেছে এবং টাকা না দিলে ছাড়বে না। এরপরই ভোর সাড়ে ৫টায় চার হাজার টাকা নিয়ে রায়হানের চাচা হাবিব উল্লাহ ফাঁড়িতে গেলে কর্তব্যরত ব্যক্তিরা তাকে ১০টার সময় ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন।

তিনি ১০টায় টাকা নিয়ে গেলে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজে যেতে বলা হয় এবং সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে ৭টা ৪০ মিনিটে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে এবং ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে।

মামলায় রায়হানের স্ত্রী উল্লেখ করেন যে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনেই মৃত্যু হয়েছে রায়হানের।

এদিকে প্রথম অবস্থায় পুলিশ কাস্টঘরে গণপিটুনির ঘটনার দাবি করলেও এলাকার সবকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে ওই ওয়ার্ডের সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম জানান যে রাত ১২টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কাস্টঘরে এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ ঘটনায় পরিবারের দায়ের করা মামলা নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু আইনেই রুজু হয়েছে এবং এ আইনের আলোকেই তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই রাতে ফাঁড়িতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকে জেরা করে কী হয়েছিল জেনে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

এদিকে এ ঘটনায় আজ বিকেল ৪টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রতিবাদী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সিলেটে নবগঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’।

আরও পড়ুন:

রায়হান হত্যা: সিসি ক্যামেরার ফুটেজে গণপিটুনির প্রমাণ নেই

পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ: অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা

সিলেটে পুলিশি নির্যাতনে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago