শুধু রান করা নয়, সিনিয়রদের দায়িত্ব আরও বেশি কিছু
রানের জন্য চলছিল হাহাকার। প্রথম ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ একাদশের ১৯৬ রান পেরোতে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল শান্ত একাদশের। পরের ম্যাচে অবস্থা আরও সঙিন! মাত্র ২৩.১ ওভারে ১০৩ রানে পাততাড়ি গুটিয়েছিল তামিম একাদশ। সেই লক্ষ্য তাড়ায় জয়ী হলেও মাহমুদউল্লাহ একাদশ শুরুতে করেছিল হাঁসফাঁস। স্কোরবোর্ডে কোনো রান ওঠার আগেই সাজঘরে ফিরেছিলেন দলটির তিন ব্যাটসম্যান।
বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপ দিয়ে সাত মাস পর দেশে ফিরেছে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো আভাস মেলেনি প্রথম দুই ম্যাচে। গত বৃহস্পতিবার অবশ্য চিত্র কিছুটা পাল্টায়। তৃতীয় ম্যাচে এসে প্রথমবারের মতো আসরে দুইশো পেরোয় তামিম একাদশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় তা-ই বা কম কীসে! নয়ে নেমে ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে নজর কাড়েন তরুণ শেখ মেহেদী হাসান। লক্ষ্য তাড়ায় নামা শান্ত একাদশের হয়ে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি তুলে নেন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ মুশফিকুর রহিম।
এ ম্যাচে সম্ভাবনা জাগিয়ে ঝরে পড়া কিছু ইনিংসেরও দেখা মেলে। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল, যুব বিশ্বকাপজয়ী দলের শাহাদাত হোসেন দিপু ও ঘরোয়া ক্রিকেটের চেনা মুখ ইরফান শুক্কুর ফেরেন আশা জাগিয়ে।
সবকিছু দেখে স্বস্তি মিলেছে বেশ। আটকে থাকা দমটা ছেড়ে দিয়ে বুক ভরে লম্বা নিঃশ্বাস নেওয়ার উপকরণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে দেশের ক্রিকেট অনুরাগীরা অন্তত আলোচনার খোরাক পেয়েছেন, সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রশ্মির সম্ভাবনা দেখতে শুরু করেছেন- মাঝের লম্বা বিরতির জড়তা কাটিয়ে ‘ব্যাটসম্যানরা রানে এই ফিরলেন বলে’!
সামনে এগোনোর আগে বলে রাখা দরকার, মানদণ্ডের বিবেচনায় বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপের পারফরম্যান্স নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। কারণ, ঘরোয়া মৌসুম শুরুর আগে খেলোয়াড়দের ফের প্রতিযোগিতার আবহে অভ্যস্ত করতেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) এই আয়োজন। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, প্রাপ্তির খাতায় যোগ হওয়ার মতো অনেক কিছুই মিলতে পারে ‘প্রস্তুতিমূলক’ এই আসর থেকে। প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে তা যেমন সত্য, উঠতি ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও তেমন। আর উদীয়মানদের জন্য উদাহরণ তৈরি করার দায়িত্বটা তো তারকাদেরই!
মুশফিকের প্রসঙ্গে আসা যাক। রান পাবেন, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক, সবখানেই তো তিনি রানমেশিন। আসরের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পথে আরও একবার নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন তিনি। শান্ত একাদশ ১৪ রানে ২ উইকেট হারানোর পর গিয়েছিলেন ক্রিজে। এরপর এক প্রান্তে উইকেট পড়েছে, কিন্তু মুশফিক অপর প্রান্তে ছিলেন অবিচল। ছন্দে থাকলে যা হয়- কী শট খেলেননি! অর্থোডক্স থেকে আন-অর্থোডক্স, সবই বেরোয় তার ব্যাট থেকে।
প্রথম ম্যাচে রান পাননি। তার আগে দুটি দুই দিনের প্রস্তুতি ম্যাচেও ব্যাট হাসেনি। তাই একটা তাড়নাও হয়তো ছিল অভিজ্ঞ মুশফিকের। তার ব্যাট থেকে আসে ১০৯ বলে ১০৩ রান। ইনিংসটি ছিল ৯ চার ও ১ ছয়ে সাজানো। ষষ্ঠ উইকেটে শুক্কুরের সঙ্গে ৫৯ রানের জুটির পর নবম উইকেটে তাসকিন আহমেদকে নিয়ে যোগ করেন ৩৯ রান।
কিন্তু কিছুটা অতৃপ্তিও থেকে গেছে। মুশফিক ম্যাচটা শেষ করে আসতে পারেননি। নিজের ভুলে হয় তার ইনিংসের সমাপ্তি। র্যাম্প শট খেলতে গিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের শিকার হন তিনি। ওই সময়ে স্কুপ করা মোটেও সুবিবেচনা প্রসূত ছিল না। তখন জয়ের জন্য শান্ত একাদশের প্রয়োজন ছিল ৩৪ বলে ৪৯ রান। শেষ পর্যন্ত তারা হেরে যায় ৪২ রানের বড় ব্যবধানে।
মুশফিক যেভাবে ব্যাটে-বলে সংযোগ করছিলেন, উইকেট বিলিয়ে দিয়ে না আসলে ম্যাচের ফল যে তাদের দিকে যেত, সে বাজি ধরাই যায়। তবে আসরের যেহেতু ‘লিস্ট এ’ মর্যাদাও নেই, তাই জয়-পরাজয় নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্চ্য হচ্ছে না। কিন্তু এমনটা যদি ঘটত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে? তীরে গিয়ে ডুবত তরী? তাহলে?
সেই যন্ত্রণা কতটা তীব্র, তার ক্ষত মুছে যেতে কতটা সময় লাগে তা মুশফিকেরই সবচেয়ে ভালো জানা! দুঃসহ স্মৃতিটা ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। সেদিন ভারতের বিপক্ষে মুঠোয় থাকা জয় হাতছাড়া হয়েছিল বাংলাদেশের। ৩ বলে ২ রানের সমীকরণ অবিশ্বাস্যভাবে মেলানো যায়নি। শট নির্বাচনে গড়বড় করেছিলেন মুশফিকও। পরে ওই হারকে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ‘সবচেয়ে হতাশাজনক’ অধ্যায়ও বলেছিলেন তিনি।
এরপর অবশ্য জল গড়িয়েছে অনেক। মুশফিক নিজেকে শুধরে নিয়েছেন। ম্যাচ শেষ করে বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়ার অভ্যস্ততা তৈরি করেছেন। কিন্তু তামিম একাদশের বিপক্ষে অভ্যস্ততার ছাপটা রাখতে না পারায় বিফলে যায় তার সেঞ্চুরি। তাতেই যা অস্বস্তি থেকে গেল।
নজর দেওয়া যাক তামিমের দিকে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরুর আগে মুশফিকের মতো তিনিও শট নির্বাচনে আরও সাবধানী হতে পারেন। তবে তরুণ স্পিনার নাঈম হাসান তাকে যেভাবে ফাঁদে ফেলেন, সেটাও ছিল দেখার মতো।
অফ-স্পিন ডেলিভারি টার্ন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল বাইরে। বাঁহাতি তামিম পা অনেকটা লম্বা করে বাড়িয়ে খেলার চেষ্টা করেন। বল অনুসরণ করে শরীর থেকে অনেক দূরে ব্যাট চালান তিনি। আলতো টোকা লেগে বল চলে যায় স্লিপে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন রিশাদ হোসেন। থিতু হওয়া তামিম বিদায় নেন ৪৫ বলে ৩৩ রান করে।
সবশেষে প্রাপ্তির খাতায় যোগ হওয়ার আলোচনা। জাতীয় দল, জাতীয় দলের আশেপাশে থাকা ক্রিকেটার ও যুব বিশ্বকাপজয়ীদের নিয়ে মাঠে গড়িয়েছে বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপ। অর্থাৎ দেশের নামিদামি তারকাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে খেলার সুযোগ মিলছে তরুণদের, মিলছে তাদেরকে খুব কাছ থেকে দেখে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ।
তা-ই এই আসর দিয়ে লম্বা সময় পর ক্রিকেটে ফেরা মুশফিক-তামিমরা নিজেদের অস্ত্রে যেমন শাণ দিতে পারেন, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারেন, তেমনি তরুণদেরকেও শেখাতে পারেন চাপের মুখে ইনিংস বড় করা কিংবা ম্যাচ শেষ করে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
Comments