রাতে এল ক্লাসিকো: বার্সা-রিয়াল মহারণ
এ ম্যাচের আবেদনই আলাদা! ভক্ত-সমর্থক মহলে বিরাজ করে অন্যরকম উন্মাদনা, উত্তেজনা। স্পেন থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকে অধীর আগ্রহ নিয়ে। ক্লাব পর্যায়ের অন্য কোনো দ্বৈরথ নিয়ে এতটা আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক আর চোখে পড়ে না। এর পরতে পরতে সৌন্দর্য, বিস্ময় আর রোমাঞ্চের হাতছানি।
এল ক্লাসিকো- স্প্যানিশ ফুটবলের দুই পাওয়ার হাউজ বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের শৈল্পিক লড়াই।
লা লিগায় শনিবার চলতি মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকোতে মাঠে নামছে দুদল। লিওনেল মেসিরা নিজেদের মাঠ ক্যাম্প ন্যুতে আতিথ্য দেবে সার্জিও রামোসদের। ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত আটটায়।
বর্তমান চিত্র:
খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল। উভয়েই লিগে নিজেদের শেষ ম্যাচে হেরেছে। গত সপ্তাহে রিয়ালকে তাদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে স্তব্ধ করে দিয়েছিল কাদিজ। দ্বিতীয় বিভাগ থেকে উঠে আসা দলটি লস ব্লাঙ্কোসদের বিপক্ষে জিতেছিল ১-০ গোলে। একই ব্যবধানে গেতাফের কাছে হেরে যায় বার্সাও। অথচ দলটির বিপক্ষে ২০১১ সাল থেকে লিগে অপরাজিত ছিল কাতালানরা।
এরপর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ফেরেন্সভারোসকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে বার্সেলোনা ঘুরে দাঁড়ালেও রিয়ালকে বার্নাব্যুতে আরেকটি বিব্রতকর হারের তেতো স্বাদ দেয় শাখতার দোনেস্ক। ইউক্রেনের ক্লাবটির মূল একাদশের দশ খেলোয়াড় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে খেলতে পারেনি। তারপরও তারা তুলে নেয় ৩-২ ব্যবধানের স্মরণীয় জয়। এমনকি প্রথমার্ধ শেষেই সফরকারীরা এগিয়ে ছিল তিন গোলে!
পয়েন্ট তালিকায় অবস্থান:
লা লিগার ছয় রাউন্ডের খেলা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বার্সা ও রিয়াল অবশ্য এবারের মৌসুম শুরু করেছে কিছুটা দেরিতে। তারপরও পয়েন্ট তালিকায় তাদের অবস্থান বরাবরের মতো নয়।
পাঁচ ম্যাচে তিন জয়, এক ড্র ও এক হারে ১০ পয়েন্ট নিয়ে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন রিয়াল আছে তিনে। শিরোপা পুনরুদ্ধারের অভিযানে বার্সার শুরুটাও হয়নি প্রত্যাশা অনুযায়ী। চার ম্যাচে দুই জয়, এক ড্র ও এক হারে তাদের অর্জন ৭ পয়েন্ট। তালিকায় তাদের অবস্থান দশম।
দুই কোচের হালচাল:
টানা দুই ম্যাচে হার যে এল ক্লাসিকোর আদর্শ প্রস্তুতি নয়, তা ফুটবল অনুরাগী মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। রিয়াল কোচ জিনেদিন জিদানের তোপের মুখে পড়া কিংবা চাপের মধ্যে থাকাটাও তাদের উপলব্ধির বাইরে নয়। কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ফরাসি তারকা ফুটবলার নিজে কী ভাবছেন?
শাখতারের বিপক্ষে হারের পর জিদান সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে সরাসরি কিছু না বললেও এল ক্লাসিকোতে ‘দেখিয়ে দেওয়া’র হুঙ্কার দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আগে কী ঘটেছে সেসব না ভেবে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ দেওয়ার জন্য তিনি সেরা মঞ্চটাকে বেছে রেখেছেন। এখন তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় কিনা তা দেখার পালা।
কয়েক মাস আগে দায়িত্ব নেওয়া বার্সা কোচ রোনাল্ড কোমানের এটি প্রথম এল ক্লাসিকো। তবে এ ম্যাচের আবহ, ঝাঁজ, তাৎপর্য- সবই তার জানা। কারণ, এক সময় বার্সেলোনার হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের সাবেক এই খেলোয়াড়।
গত মৌসুমে ভরাডুবির অভিজ্ঞতা পাওয়া বার্সায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন কোমান। ইতোমধ্যে অনেক তারকা খেলোয়াড়কে ছেড়ে দিয়েছেন, খেলার কৌশলেও এনেছেন পরিবর্তন। মেসির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা কমানোর মনোভাবও প্রকাশ পেয়েছে তার আচরণ ও কাজে। তার এসব সিদ্ধান্তের বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা যতটা না হয়েছে এখন পর্যন্ত, তার চেয়ে বহুগুণে হবে রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচের পর। তাই কোমানের জন্য এটি নিজেকে প্রমাণের আদর্শ জায়গাও বটে।
স্কোয়াডগুলোর খবরাখবর:
গত মৌসুমের শেষে বার্সা ছাড়তে আগ্রহ প্রকাশ করা মেসির সেরাটা এখনও দেখা যায়নি এবার। লিগের চার ম্যাচে আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড জালের দেখা পেয়েছেন একবার, তা-ও পেনাল্টি থেকে। করেননি কোনো অ্যাসিস্ট।
রিয়ালের আক্রমণভাগে চলছে দৈন্যদশা। দলটি পাঁচ ম্যাচে গোল করেছে মাত্র ছয়টি। ফরোয়ার্ডদের কাছ থেকে এসেছে মোটে তিন গোল।
চোট সমস্যা ভোগাচ্ছে দুদলকে। বার্সার জর্দি আলবাকে নিয়ে দোটানা রয়েছে। গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেন ও ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতি ছিটকে গেছেন। রিয়ালের অবস্থা বেশি বেগতিক। তারকা ফরোয়ার্ড এদেন হ্যাজার্ড, ডিফেন্ডার দানি কারভাহাল, মিডফিল্ডার মার্টিন ওডেগার্ডকে পাচ্ছে না তারা। পাশাপাশি কাসেমিরো খেলতে পারবেন কিনা তা নিশ্চিত নয়।
দর্শকশূন্য স্টেডিয়াম:
এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে বার্সা ও রিয়ালের মধ্যে। এর রোমাঞ্চ, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতেও। কিন্তু এবার চিত্র থাকবে ভিন্ন। করোনাভাইরাসের কারণে প্রথমবারের মতো দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে এল ক্লাসিকো।
এবং মেসি:
২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বার্সা-রিয়ালের আরও একটা অর্থও ছিল। সময়ের দুই সেরা ফুটবলারের লড়াই। একদিকে মেসি, অন্যদিকে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। ফুটবলে বুঁদ হতে আর কি চাই!
বছর দুই আগে পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড রোনালদো ছেড়ে গেছেন রিয়াল। তিনি পাড়ি জমিয়েছেন ইতালিয়ান পরাশক্তি জুভেন্টাসে। তাতে এল ক্লাসিকোর জৌলুশ নিঃসন্দেহে কমেছে। ধারাটা অবশ্য চলছিল আগে থেকেই। তার আগের বছরই যে ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারও বার্সা ছেড়ে নাম লেখান প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতে (পিএসজি)।
বাকি রইলেন মেসি। ৩৩ বছর বয়সী এই তারকা এতদিনে হয়তো অন্য কোনো ক্লাবে যোগ দিয়ে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেও ফেলতেন! যদি না বার্সা বোর্ড বাগড়া দিত। তাই অনেক জল্পনা-কল্পনার পরও ন্যু ক্যাম্প ছাড়া হয়নি তার।
তবে বার্সার সঙ্গে মেসির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে চলতি ২০২০-২১ মৌসুমের শেষে। গত মৌসুমের শেষের ঝড় থামার পর নবায়নের আলোচনার বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। তাই ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মৌসুম থেকে এল ক্লাসিকোতে দেখা যাবে না তাকে। আর তা-ই যদি হয়, শেষটা রাঙানোর ইচ্ছা নিশ্চয়ই থাকবে মেসির?
মেসি কি পারবেন বার্সাকে পূর্ণ পয়েন্ট এনে দিতে? নাকি রিয়াল হাসবে শেষ হাসি? নাকি লড়াই হবে অমীমাংসিত? অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টার।
Comments