সাংবিধানিকভাবে মেনে নিয়েছি, গণতন্ত্রের জন্য আমরা উপযুক্ত নই: জিএম কাদের
[করোনা মহামারির কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি বা কার্যক্রম প্রায় অনুপস্থিত। তাই আমরা এমন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাক্ষাৎকার আপনাদের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছি, যারা আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বাধীন জোটে নেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থেকে নির্বাচন করলেও জাতীয় পার্টি সরকারে নেই। সাক্ষাৎকারে তারা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন, নিজেদের দলের কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন।
আশা করি বিশ্লেষণমূলক সাক্ষাৎকারগুলো আপনাদের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তাজগতকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
আজ প্রকাশিত হলো জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সাক্ষাৎকার। এরপর প্রকাশিত হবে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলমের সাক্ষাৎকার। -সম্পাদক]
এদেশের রাজনীতিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‘স্বৈরাচার’ হিসেবে স্বীকৃত। যদিও তিনি তা কোনোদিন স্বীকার করেননি, স্বীকার করেন না এখনকার নেতৃত্বও।
সামরিক শাসক এরশাদের গড়া রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি। তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সংসদে রয়েছে দলটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করলেও সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টি।
দেশের বর্তমান অবস্থা, দলটির বর্তমান অবস্থা, মানুষের মনে থাকা প্রশ্নসহ নানা বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। আলোচনায় উঠে এসেছে ৭০ ধারার কারণে সংসদে এমপিদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা, বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির অবস্থানসহ নানা বিষয়।
দ্য ডেইলি স্টার: জাতীয় পার্টি কি সরকারের অংশ, না বিরোধী দলের? আপনার কী মনে হয় যে মানুষের ভেতরে এমন কনফিউশন আছে?
গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের): মানুষের মাঝে এই কনফিউশন আছে। এর কারণও আছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, আমরা যে জোট করেছিলাম ২০১৮ সালের নির্বাচনে, সেটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে। সে সময় আমাদের মহাজোটের নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তার পক্ষে কথা বলতে হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের এবং আমাদের একই নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। ফলে আমরা একই ধরনের কথা বলেছি। নির্বাচনে আর অন্য কোনো দল যেহেতু তেমন সিগনিফিকেন্ট আসন নিয়ে সংসদে আসেনি, কাজেই সংসদে বিরোধী দল হিসেবে বক্তব্য দেওয়া বা বিরোধী দলের কাজগুলো করার জন্য একটি দল দরকার। পরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সংসদে বিরোধী দল হিসেবে কাজ করব। তার আগ পর্যন্ত যেহেতু আমরা একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছি, আমরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছি, আওয়ামী লীগ আমাদের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছে, আমরা একই সুরে কথা বলছি, একই এজেন্ডা নিয়ে কথা বলছি, কাজেই মানুষের মধ্যে তো কনফিউশন থাকতেই পারে।
ডেইলি স্টার: একসঙ্গে নির্বাচন করে তারপর আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে একটা বিরোধী দল থাকতে হবে! জাতীয় পার্টি নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনা আছে। এতে জাতীয় পার্টির ইমেজের ক্ষতি হলো, না লাভ হলো?
জিএম কাদের: এটা যে যেভাবে নেয়। কতগুলো বাস্তবতা আছে। আমরা সরকারের অংশ হলে সংসদ চলতে পারত, যেটা মোটামুটি একদলীয় সংসদ। যেখানে কোনো প্রতিবাদ হবে না, সবাই একই সুরে কথা বলবে। সেক্ষেত্রে সংসদের যে মেইন ফাংশন আমরা আশা করি, সরকারের ভারসাম্য রক্ষার তা আর থাকবে না। সেখানে সংবিধান মোতাবেক আমরা বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়িয়েছি। বিরোধী দল মানেই শত্রু নয় কিন্তু। বিরোধী দল প্রতিপক্ষ হতে পারে, শত্রু নয়। আমরা সকলেই দেশের জন্য কাজ করছি। বিরোধী দল এবং সরকার, সবাই দেশের জন্য কাজ করছে। হয়তো আমার আর তার দৃষ্টিভঙ্গি এক নাও হতে পারে, আবার কোনো সময় এক হতেও পারে। আমার একটা পরামর্শ সরকার গ্রহণ করতে পারে, নাও করতে পারে। কিন্তু, বিরোধী দল হলেই সরকারকে শত্রু মনে করতে হবে, সরকারকে গালাগালি করতে হবে, সরকারের সব বিষয়ে বিরূপ মনোভাব নিয়ে দাঁড়াতে হবে, এই কনসেপ্টটা ঠিক না বলে আমি মনে করি।
বর্তমান যে পরিস্থিতিতে আমাদের বিরোধী দলের ভূমিকা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে এবং আমরা যার জন্য রাজি হয়েছি, সেটাতে দেশ উপকৃত হয়েছে। এর বিকল্প ছিল বিরোধী দল বিহীন একটি সংসদ।
আমি মনে করি আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে যারা একমত হতে পারবেন না, তারা এমন ধারণার মধ্যে আছেন যার যুক্তি নেই।
ডেইলি স্টার: আপনারা বিরোধী দলের জায়গায় কাজ করতে চাইলেন। কিন্তু আপনারা তো তা করছেন না, বা করতে পারছেন না।
জিএম কাদের: আমরা পারলাম না সেটা কোথায় পেলেন?
ডেইলি স্টার: সুশাসনহীনতা, জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির মতো জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিষয়ে আপনাদের জোরালো কোনো অবস্থান নিতে দেখা যায় না।
জিএম কাদের: আমরা প্রতিটি বিষয়ে কথা বলেছি। ভোটের কথা বললেন, সেগুলো আমরা সংসদে বলেছি এবং তা লিপিবদ্ধও আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি, তাও লিপিবদ্ধ করা আছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছি, আরও অনেক বিষয় আমরা সংসদে তুলে ধরেছি। সরকারের যেখানে যেখানে গাফিলতি সেগুলো আমরা তুলে ধরেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ওয়াসার গাফিলতি তুলে ধরেছি। বিভিন্ন সময় মানুষের জনজীবনে যা সমস্যা সৃষ্টি করেছে তার সমস্ত বিষয় আমরা তুলে ধরেছি। সংসদের বাইরেও আমরা এসব নিয়ে বক্তব্য দিয়েছি।
ডেইলি স্টার: বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক বা আইনের যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, জাতীয় পার্টির প্রধান হিসেবে সেই পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
জিএম কাদের: দেশের সাধারণ নাগরিক এগুলোকে যেভাবে দেখছেন আমরাও সেভাবেই দেখছি। এগুলোকে আমরা ভালোভাবে দেখছি না। আমরা এগুলোর প্রতিবাদ করছি। আমরা এগুলোর জন্য বিকল্প প্রস্তাবও দিচ্ছি যে কী করলে এগুলো থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। তার মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে সরকার ব্যবস্থাও নিয়েছে। সংসদে এবং সংসদের বাইরে বিরোধী দল কেবল কথা বলতে পারে, দাবি করতে পারে। আমাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে সরকার একক ক্ষমতার অধিকারী। সরকারের ক্ষমতার ব্যালেন্স করতে সংসদে বিরোধী দলের যে ভূমিকা তা আমাদের দেশে কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে না। সরকার এবং সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সেখানে আমাদের বক্তব্যগুলো শুধু জনগণকে জানানোর জন্য যে আমরা কথা বলছি এবং সরকারকে জানানোর জন্য যে আমরা জনগণের কথা বলছি।
ডেইলি স্টার: বর্তমানে দেশের সুশাসনের অবস্থা কেমন?
জিএম কাদের: আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে সব সময় কথা বলছি। ৯১' এর পর থেকে আমাদের দেশে যে শাসনব্যবস্থা আমরা প্রচলন করেছি, সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংসদ সদস্যদের কার্যক্রমকে ৭০ ধারার মাধ্যমে সীমিত করা হয়েছে, একতরফা করা হয়েছে। যার কারণে সংসদের কাছে সরকারের যে জবাবদিহিতা করার কথা রয়েছে, তা হচ্ছে না। এটাই হলো বাস্তবতা। জবাবদিহিতার অভাব হলে কোনোদিন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। এটা আজকে শুরু হয়নি। ৯১' এর পর থেকে কোনো সরকারের সময় যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান প্রতিষ্ঠান সংসদকে কার্যকর করা যায়নি, সেহেতু আমরা ধরেই নিয়েছি একতরফা ভাবেই সংসদ চলবে। এটা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এককভাবে এর জন্য আমি কাউকে দায়ী করব না। ৯১' এর পর থেকে প্রতিটি সরকার সুশাসনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে। এভাবে আমরা সুশাসনের ক্ষেত্রে পেছনের দিকেই যাচ্ছি।
ডেইলি স্টার: একটি কথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে দুর্নীতি এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। সেই প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির আলোচনা চাপা পড়ে গিয়ে পরবর্তীতে দুর্নীতির যে বিস্তার আমরা বিএনপির সময়ে এবং এখন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেখছি সেটা নিয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আপনাদের বা আপনার বিশ্লেষণ কী?
জিএম কাদের: আমরা তো অনেক আগেই বলেছি, এরশাদ সাহেবের সময় দুর্নীতির হার পরবর্তী সময়ের চেয়ে অনেক কম ছিল। এখনকার সময়ের হিসেবে সেটা একেবারেই নগণ্য ছিল বলা যায়।
ডেইলি স্টার: তখন হয়তো সরকারের টাকার পরিমাণ কম ছিল, তাই দুর্নীতির পরিমাণ কম ছিল।
জিএম কাদের: তখনকার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দুর্নীতির ঘটনা দেশে এখন প্রতিদিনই ঘটছে। প্রতিটি সরকারের আমলে এটা বাড়ছে। কোনো সরকারের আমলে এটা কমছে না। এরশাদ সরকারের আমলে আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হইনি। পরবর্তীতে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কাজেই দুর্নীতি তো বেড়েই চলেছে, এটা তো আর নতুন করে বলার প্রশ্ন আসে না। বিশ্বব্যাপী বিভিন্নভাবেই এটা বোঝা যাচ্ছে। এরশাদ সাহেবকে দোষারোপ করাটা আমার কাছে খুব অন্যায় বলে মনে হয়। এরশাদ সাহেবের শাসনামল এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে সুশাসনের দিক থেকে খারাপ কী ছিল? আর দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ করা হয়েছে এরশাদ আমলে, এগুলো কথার কথা। তিনি স্বৈরাচার ছিলেন, সেটা কথার কথা। কারণ, আমরা সবাই জানি এরশাদ সাহেবের পর থেকে দেশের শাসন ব্যবস্থা আমরা স্বৈরাচারী করেছি। সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র করে সেই সংসদ ব্যবহার করে শাসন ব্যবস্থাকেই আমরা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় পরিণত করেছি।
ডেইলি স্টার: আপনি একজন রাজনীতিবিদ। এখন যে ভোটার ছাড়া নির্বাচনের অভিযোগ আসে, দিনের ভোট রাতেই হয়ে যায় বলে যে অভিযোগ আসে, একজন রাজনীতিবিদ বা এমপি হিসেবে এটা কীভাবে দেখেন? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো আত্মজিজ্ঞাসা করেছেন?
জিএম কাদের: যে কোনো ভালো জিনিসকে সবাই পছন্দ করে, আর যে কোনো খারাপ জিনিসকে সবাই অপছন্দ করে। আমি তার বাইরে নই। বাইরে কে কী বলল সেটা বড় কথা না। সত্যটা তো মানুষ দেখছে, জানছে। আমি মনে করি আমাদের দেশে গণতন্ত্রের একটাই কাঠামো হচ্ছে নির্বাচন। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে এসেছি, কিন্তু তা কার্যকর নয়। সংসদ কখনো কার্যকর হলো না। নির্বাচন যখন গণতন্ত্রের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে যায়, সেটাকে বলা হয় ডেমোক্রেসি ফর ওয়ান ডে। সেই ধারাও কার্যকর থাকলো না। কত ভালো বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো তাতে বোঝা যায় কতটা গণতন্ত্র আমাদের আছে। আর সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে গণতন্ত্র, সেটা সাংবিধানিকভাবে আমরা ব্লক করে রেখেছি। ডেমোক্রেসি ফর ওয়ান ডে-ও আমরা অনেক সময় ধরে রাখতে পারিনি। এটা সব সরকারের আমলেই হয়েছে কম বেশি। সবাই যে সাধু তা নয়।
ডেইলি স্টার: জাতীয় পার্টি প্রসঙ্গে আসি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন তখন সকালে এক কথা আবার বিকালে অন্য কথার রীতি ছিল। দলের মধ্যে এখন একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আবার একটু পর আরেক জনকে দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টি কি এখনো সেই ধারাতেই আছে? আপনারা কি সেই ধারাতেই থেকে গেলেন?
জিএম কাদের: এরশাদ সাহেবকে ম্যালাইন করার জন্য এ কথাগুলো অনেক সময় বলা হয়। সিদ্ধান্ত তো পরিবর্তন হতেই পারে। একটি সিদ্ধান্ত অন্য একটি সিদ্ধান্তের বিপরীতে যেতেই পারে। এটা যে এককভাবে এরশাদ সাহেবই করতেন, তিনি ছাড়া আর কেউ এমন করেন না সেটা ঠিক না। বোঝাপড়া এবং সমন্বয়ের মাধ্যমেই রাজনীতি করতে হয়। এরশাদ সাহেব পরবর্তী সময়ে আমরা যেভাবে দল চালাচ্ছি সেখানে আমাদের কেউ বলতে পারবে না যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখান থেকে পিছিয়ে আসছি। এরশাদ সাহেবের সময় প্রতিপক্ষ দুটি দলের দ্বারা যে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেখানে একটি উত্তাল সমুদ্রে জাতীয় পার্টিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। সেখানে ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাকে কখনো উপরে উঠতে হয়েছে, কখনো নিচে নামতে হয়েছে। কোনো সময় ডানে চলতে হয়েছে, কোনো সময় বামে চলতে হয়েছে। সেটা না হলে দলটাকে তিনি বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না। সে হিসেবে ওনাকে অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়েছে। রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় কথাটা হলো টিকে থাকা। টিকে থাকলে তারপর না আমি মানুষের জন্য ভালো-মন্দ কিছু করতে পারব।
ডেইলি স্টার: আপনারা কি এখনো সেই টিকে থাকার সংগ্রামে আছেন?
জিএম কাদের: প্রতিটি রাজনৈতিক দল সব সময় টিকে থাকার সংগ্রামে থাকে।
ডেইলি স্টার: অন্যদের চেয়ে জাতীয় পার্টির বিষয়টি আলাদা কিনা। প্রশ্ন আছে, জাতীয় পার্টি কে পরিচালনা করেন? আপনারাই করেন, নাকি অন্য কোথাও থেকে পরিচালিত হয়?
জিএম কাদের: আমরা পরিচালনা করি। আপনি আমাদেরকে নিয়ে যে প্রশ্ন করছেন, যে সন্দেহ করছেন যে আমাদের দল আমরা চালাই না, আওয়ামী লীগ চালায়, সন্দেহটা ঠিক নয়। আর এই সন্দেহ করতে গেলে প্রতিটা রাজনৈতিক দলকে নিয়ে করতে পারেন। প্রতিটি দলেই কিছু ইনফ্লুয়েন্স থাকে। এমনকি, দেশ চালাতে গেলেও অনেক ইনফ্লুয়েন্স মোকাবিলা করে সরকারকে চলতে হয়।
ডেইলি স্টার: প্রশ্ন হচ্ছে, এই ইনফ্লুয়েন্স শুনে আপনাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন, নাকি সেই অনুযায়ীই চলতে হচ্ছে?
জিএম কাদের: আমাদের কোনো বিচ্যুতি হচ্ছে না এবং আমাদেরকে সেই কথা শুনেও কাজ করতে হচ্ছে না। আমরা নিজেদের দল চালাতে যেটা ভালো সেটা করছি। আমরা যেহেতু এক সঙ্গে নির্বাচন করেছি, জোটে থেকে নির্বাচন করেছি, সেই বন্ধুত্বের খাতিরে আমরাও আওয়ামী লীগকে কিছু বিষয়ে বলি আওয়ামী লীগও আমাদের কিছু বিষয়ে বলে। কিন্তু, পার্টির স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু আমরা গ্রহণ করেছি তেমন উদাহরণ কেউ দিতে পারবে না। আমার মনে হয় এগুলো কথার কথা, বলা হয় রাজনৈতিক কারণে।
ডেইলি স্টার: এক সময় জাতীয় পার্টির জাতীয় পর্যায়ের যে শক্তি ছিল, পরবর্তীতে রংপুর বা উত্তরাঞ্চলভিত্তিক যে শক্তি দেখা যেত, সেটা এখন কোন অবস্থায় আছে? জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থান কী? জাতীয় পার্টি কি জাতীয় দল থাকছে, নাকি আঞ্চলিক দলে পরিণত হচ্ছে?
জিএম কাদের: জাতীয় পার্টি- জাতীয় পার্টিই আছে। জাতীয় পার্টি কোনো সময়ই আঞ্চলিক পার্টি ছিল না। আমরা উত্তরবঙ্গভিত্তিক দল নই। উত্তরবঙ্গের মানুষ আমাদেরকে তাদের নিজস্ব দল বলে মনে করেন। সেখানকার মানুষ মনে করতেন তারা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, নিপীড়িত। কেননা তাদের কোনো লিডারশিপ নেই। এরশাদ সাহেবের মধ্যে তারা তাদের সেই লিডার খুঁজে পেয়েছেন এবং এর সুফলও তারা পেয়েছেন। কিন্তু, জাতীয় পার্টি সারা দেশের জন্যই উন্নয়ন করেছে। সারা দেশেই আমাদের এমপি আছে, সারা দেশেই আমাদের সংগঠন আছে। আগামীর বড় সম্ভাবনার দল জাতীয় পার্টি, এটা আমি আমার অন্তরের বিশ্বাস থেকে বলছি।
ডেইলি স্টার: সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে কি আপনারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে?
জিএম কাদের: আমরা জোট করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হইনি।
ডেইলি স্টার: তাহলে কি চাপে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন?
জিএম কাদের: ক্ষতিগ্রস্ত যদি কোনো কারণে হয়েও থাকি সেটা ভিন্ন কারণে। সেই কারণটা এখন আমি বলব না। তবে জোট করার জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হইনি।
ডেইলি স্টার: সামগ্রিকভাবে ৯১, ৯৬ বা ২০০৮ এ যে নির্বাচন হয়েছে তেমন নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেন, নাকি ২০১৪ বা ২০১৮ তে যেমন নির্বাচন হয়েছে, সেটাই আমাদের ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
জিএম কাদের: কী বলব...। আমি তো ভবিষ্যতদ্রষ্টা নই। তবে, আমি স্বপ্ন দেখি একটি সঠিক ও সুন্দর নির্বাচনের। ৯৬ থেকেই আমি নির্বাচন করে আসছি। আমি পাশ করেছি জনগণের ভোটে। জনগণের ভালোবাসা পেয়েছি।
ডেইলি স্টার: বর্তমান সময়ের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, ধর্ষণ, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলা হচ্ছে। এমন একটি অবস্থা কেন তৈরি হচ্ছে?
জিএম কাদের: এই প্রত্যেকটি কথা আমি বলেছি। গণমাধ্যমে আমার এই কথাগুলো এসেছে। এগুলোর সবচেয়ে বড় কারণ হলো সুশাসনের অভাব। আর সুশাসনের অভাব হওয়ার কারণ হলো জবাবদিহিতার অভাব। জবাবদিহিতার কোনো সিস্টেম আমরা তৈরি করতে পারিনি। ৯১' এর পর থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ঢুকে সিস্টেমটা আমরা নষ্ট করে ফেলেছি।
ডেইলি স্টার: আপনারা রাষ্ট্রপতি শাসনকেই কার্যকর মনে করেন, সংসদীয় ব্যবস্থা নয়?
জিএম কাদের: না, সংসদীয় গণতন্ত্র দেশের কোনো উপকারে আসেনি। সংসদে কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। ৭০ ধারা দিয়ে জবাবদিহিতার পদ্ধতি রাখা হয়নি। এজন্যে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম আংশিকভাবে হলেও কিছু সংশোধন করা দরকার। আমরা একটি প্রস্তাব সংসদে দিয়েছিলাম। সংসদীয় গণতন্ত্র মানে, জনগণ ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচিত করবে তাদের মধ্য থেকে ক্যাবিনেটের সদস্য ছাড়া বাকি সবাই হবেন সাধারণ সদস্য। তাদের সবাইকেই সরকারের জবাবদিহিতার দায়িত্ব দেওয়া হবে। সেটা সরকারি দলের হোক আর বিরোধী দলের হোক। সরকারের মন্ত্রীরা খারাপ করলে, প্রধানমন্ত্রী খারাপ করলে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন এই সাধারণ সদস্যরা। এটাই হলো সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু, ৭০ ধারার কারণে সংসদে পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারেন না সংসদ সদস্যরা। এটা যদি হয় তাহলে সংসদে একটি দলের প্রধান যা বলবেন তাই হবে। যখন আপনি জবাবদিহিতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন সংসদীয় গণতন্ত্র কাজ করছে না। আমাদের চাওয়া সংসদে এমপিদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ থাকতে হবে।
ডেইলি স্টার: সেক্ষেত্রে বড় বিপদ সামনে আসবে না? সংসদ সদস্য কেনা-বেচার প্রসঙ্গ আসবে।
জিএম কাদের: এজন্যেই আমাদের প্রস্তাবে আংশিক সংশোধনের কথা বলেছি। সরকার গঠন, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব বা বাজেট পাশের মতো বিষয়গুলোতে সংসদ সদস্যরা দলের পক্ষে ভোট দিবেন। বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। এছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে তারা স্বাধীনভাবে কথা বলবেন।
কিন্তু ৭০ ধারার কঠোরতার কারণে আমাদের স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে, দেশের মানুষ ভুল মানুষকে ভোট দেন। দেশের মানুষ ভোট দিয়ে এমন মানুষকে এমপি বানান যারা বিক্রি হবে, পয়সা নিয়ে ভোট বেচা-কেনা করবে এবং সরকারকে স্থায়িত্ব দেবে না, সরকারকে কাজ করতে দেবে না। এটা বলে আমরা ৭০ ধারা তৈরি করেছি। তার মানে আমরা ধরে নিয়েছি যে আমাদের দেশের মানুষ ভোট দেওয়ার উপযুক্ত নয় অথবা গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়। এটা কিন্তু আমরা মেনে নিচ্ছি ৭০ ধারা দেওয়ার সময়। তার মানে আমরা গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নই, তা মেনে নিচ্ছি সাংবিধানিকভাবে।
ডেইলি স্টার: আপনি যা বলছেন, তা কি একেবারে অসত্য?
জিএম কাদের: কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হবে। সুশাসন চাইলে জবাবদিহিমূলক একটা পদ্ধতিতে যেতেই হবে। আপনি যে কথা বলছেন, তা যেমন অসত্য নয় আবার পুরোপুরি সত্য ধরে নেওয়াও ঠিক হবে না। আমাদের দেশের জনগণ ভোট দিতে গিয়ে কখনও ভুল করেনি। তারা যতই নিরক্ষর হোক, যতই গরীব হোক, ভোট দেওয়ার সময় ভালো মানুষটাকে বেছে নিতে পারে। তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
আমরা বলেছিলাম সংসদে আংশিকভাবে হলেও সংসদ সদস্যদের নিজেদের মতো করে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। সরকার বদলের বিষয়ে বা বাজেট পাশের মতো বিষয় ছাড়া বাকি সব জায়গায় তাদের ফ্রি করে দেন। আইন পাশ করেন, এসব জায়গায় কেউ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না। এতে সরকারের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে সমস্যা হবে না। যে কারণে ৭০ ধারা সেই আশঙ্কা থাকবে না। অন্য সব বিষয়ে বা বিলের ব্যাপারে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাও প্রয়োজনে সরকারের মতের বিপরীতে কথা বলতে পারবেন, ভোট দিতে পারবেন। তাহলে আংশিকভাবে হলেও জবাবদিহিতা আসবে। জবাবদিহিতা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।
Comments