উত্তর কোরিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র, ইরানের শক্তি ও ইসরায়েলের আতঙ্ক

North Korea
উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ব্যাপক আকারে সামরিক কুজকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ইরানের সখ্যাতা প্রায় চার দশকের। সেই সখ্যতার জেরে দেশ দুটিকে ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ রেখেছিলেন ‘অ্যাক্সিস অব ইভিল’ তথা ‘শয়তানের অক্ষশক্তি’র তালিকায়। এরপর, হোয়াইট হাউজে যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তারা বিভিন্ন অজুহাতে এই ভিন্নমতাম্বলী রাষ্ট্র দুটির ওপর চাপিয়েছিলেন বিভিন্ন রকমের অবরোধ।

তবে কোনো অবরোধই দেশ দুটিকে পরাস্ত করতে পারেনি। বরং, সামরিক দিক থেকে তারা হয়েছে আরও বেশি শক্তিশালী। সম্প্রতি, উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে দেশটি ব্যাপক আকারে সামরিক কুজকাওয়াজের আয়োজন করে।

সেই কুজকাওয়াজে প্রদর্শন করা হয় ‘হোয়াসং-১৫’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। দুইপাশে ১১ চাকা বিশিষ্ট গাড়িতে বয়ে আনা সেই ক্ষেপণাস্ত্রকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয় ‘দানব’ হিসেবে। সমরবিদরা এই ‘কৌশলগত’ অস্ত্রটিকে দেখেন ‘বৈশ্বিক হুমকি’ হিসেবে।

ইসরায়েলের জেরুসালেম পোস্টের এক প্রতিবেদনে এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি কিভাবে ইহুদি রাষ্ট্রটির জন্যে হুমকি তা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ইরানের কৌশলগত সুসম্পর্কের কারণে এই ক্ষেপণাস্ত্রের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত তথ্য চলে আসতে পারে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশটির হাতে।

বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেই উত্তর কোরিয়া নতুন অস্ত্রের ঝলক দেখাল। এর মানে, এই অস্ত্র দিয়ে ইরান সরকার ইসরায়েলকেও হুমকি দিতে পারে। এমনটি অতীতেও ঘটেছিল।

সমর বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ফ্রান্স টুয়েন্টিফোরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার সামরিক কুজকাওয়াজে যেসব নতুন অস্ত্রের মহড়া হয়েছে তা আগে দেখা যায়নি। দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বার্তা দিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি উত্তর কোরিয়ার প্রতি বেশ সদয় রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর কোরিয়া বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। গত বছর চালিয়েছে ১৩টি পরীক্ষা। গত আগস্টেও দেশটি পাঁচটি পরীক্ষা চালায়। এগুলোর মধ্যে স্বল্পমাত্রার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ৪০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়েছিল।

মার্কিন সামরিক ম্যাগাজিন দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট এর উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ হ্যারি কাজিয়ানিস মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ২০১৭ সালে পরীক্ষিত ‘হোয়াসং-১৫’ ক্ষেপণাস্ত্রের একটি সংস্করণ হতে পারে।

তার মতে, ‘তবে এটি ২০১৭ সালের সেই ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে আকৃতিতে বড় ও অনেক শক্তিশালী। এটিই এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার হাতে থাকা সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’

কিম জং-উনের এই সামরিক মহড়ায় ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ইসরায়েল। কেননা, উত্তর কোরিয়া ও ইরান তাদের সহযোগিতা নতুন করে শুরু করেছে বলে গত ২০ সেপ্টেম্বর সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়।

সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, ইরান গত কয়েক বছরে তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধি করেছে। শত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও উপসাগরীয় দেশটি তার ক্ষেপণাস্ত্রের পরিধি ও সক্ষমতা বাড়িয়েছে। অতীতের তুলনায় এখন ইরানের হাতে রয়েছে উন্নতমানের ড্রোন, রাডার ব্যবস্থা ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ইরান নতুন করে কাজ শুরু করেছে।

দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খনিজসমৃদ্ধ ইরান ১৯৮০ দশক থেকে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রের অন্যতম প্রধান ক্রেতা। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, বিশেষ করে, মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘হোয়াসং-৭’ এর মডেল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইরান ‘শাবাব-৩’ ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়েছে। কারো কারো মতে, ‘শাবাব-৩’ তৈরি করা হয়েছে উত্তর কোরিয়ার ‘নোডং-১’ এর ওপর ভিত্তি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বরাত দিয়ে এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরানের শহিদ মোভাহেদ ইন্ডাস্ট্রিজ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কাজ করছে। ফলে, ইরানের হাতে উত্তর কোরিয়ার ‘হোয়াসং-১২’, ‘হোয়াসং-১৪’ ও ‘হোয়াসং-১৫’ ক্ষেপণাস্ত্রের প্রযুক্তি চলে আসতে পারে।

২০১০ সালেই মার্কিন গোয়েন্দারা বলেছিলেন যে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে ইরান ১৯টি উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করেছে। সেগুলো রাশিয়ার মস্কোসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আঘাত হানতে সক্ষম। সমরবিশেষজ্ঞদের মতে সেগুলো ছিল ‘হোয়াসং-১০’ ক্ষেপণাস্ত্র।

তবে, এসব বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক দ্য ডিপ্লোমেট ম্যাগাজিনের জন এস পার্কের রয়েছে ভিন্ন মত। তিনি মনে করেন তেহরান ও পিয়ংইয়ংয়ের সম্পর্ক প্রতীকী। ২০১২ সালে দেশ দুটি প্রযুক্তি সহযোগিতা চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তারা কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠাতে রকেট তৈরির কৌশল নিয়ে কাজ করে। এর ফলে ইরান সফলভাবে ‘সাফির’ রকেট তৈরি করে। এরপর ‘কাসেদ’ রকেটের মাধ্যমে ইরান গত এপ্রিলে ‘নূর’ সামরিক স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করে।

ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সহযোগিতা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ১৯৮০ দশকে উত্তর কোরিয়ার উপদেষ্টা ইরানে থাকতেন। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ গোয়েন্দা বিভাগের মতে, ইরানের নৌবাহিনীর আধুনিকায়নের কাজে উত্তর কোরিয়া সহযোগিতা করেছে।

ইসরায়েল মিসাইল ডিফেন্স অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক উজি রুবিনের মতে, ইরান যে খুররমশার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে তা তারা করেছে উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতা নিয়ে। আবার উত্তর কোরিয়া ও ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে রাশিয়ার মাকিয়েভ ক্ষেপণাস্ত্র কারখানায়। সেখানে রাশিয়ার আর-২৭ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়েছিল। সেই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে পরে রূপান্তর ঘটিয়ে মোবাইল গ্রাউন্ড-লঞ্চড ক্ষেপণাস্ত্র করা হয়। ইরানের ২,০০০ কিলোমিটার পরিধির ‘শাবাব-৩’ এর উৎস সেখানেই।

গত বছর ইরান মধ্যপাল্লার ‘শাবাব-৩’ এর পরীক্ষা চালায়। এটি ইসরায়েল ও ইউরোপে আঘাত হানতে সক্ষম। সে বছরই ‘জুলফিকার’ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণ দেখায় দেশটি। গত ফেব্রুয়ারিতে ইরান স্বল্পপাল্লার ‘রাদ ৫০০’ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে।

অভিযোগ রয়েছে, ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে ইরাক ও সিরিয়ার মাটিতে- জঙ্গি সংগঠন আইএস ও সরকারবিরোধীদের দমনে। আবার একই সঙ্গে রপ্তানি করছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি।

তাই, উত্তর কোরিয়ায় কোনো সামরিক মহড়া হলে তা ইসরায়েলের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠে এই আশঙ্কায় যে সেই অস্ত্র এক সময় ইরানের হাতকে শক্তিশালী করবে। সামরিকখাতে উত্তর কোরিয়ার ক্রমিক উন্নতিকে ইসরায়েল দেখে ইরানেরও উন্নতি হিসেবে।

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

4h ago