রেফারি আজিজ: একজন সাহসী ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি
রেফারি আবদুল আজিজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গত মঙ্গলবার বিকালে। অনেক দিন ধরেই তিনি নানাবিধ রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
বড় তারকার খ্যাতি পাওয়া রেফারি আজিজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন নিঃশব্দে। কিন্তু তিনি স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ যা যা রেখে গেছেন, সেসব বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা। তবে যারা ১৯৭০ এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত ঘরোয়া ফুটবলের সোনালি সময় দেখে বেড়ে উঠেছেন, তাদের চোখে আজিজ ছিলেন দেশের ইতিহাসেরই সেরা রেফারি।
ঘরোয়া ফুটবলে, বিশেষত, আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যকার ঢাকা ডার্বিতে আজিজ যে সাহসিকতা ও মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিতেন, তা ওই হাইভোল্টেজ ম্যাচের সঙ্গে একই সমান্তরালে আলোচিত হতো।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি দর্শকের সামনে উত্তেজনায় ঠাসা সব ম্যাচ তিনি পরিচালনা করতেন শক্ত হাতে। দেশের ‘থিয়েটার অব ড্রিমস’ এর সেসময়ের নিয়মিত দর্শনার্থীদের স্মৃতিতে এখনও তা সতেজ।
স্ট্যান্ড থেকে তাকে ‘ঠ্যাঁটা আইজ্যা’ (একগুঁয়ে আজিজ) বলে স্লোগান দেওয়া হতো। মূলত তার সাহসের তারিফ করতে এ ধরনের বিশেষণে তাকে ভূষিত করা হতো। সারা দেশে ছোট-বড়, গুরুত্বপূর্ণ-গুরুত্বহীন যে খেলাই তিনি পরিচালনা করতেন না কেন, বরাবরই ছিলেন ফুটবল অনুরাগীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে।
জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে রেফারি আজিজ ছিলেন অতুলনীয়। তিনি তার ভক্তদের কাছ থেকে প্রায়শই এমন চিঠি পেতেন, যেখানে প্রাপকের পুরো ঠিকানার স্থলে কেবল ‘রেফারি আজিজ, গেন্ডারিয়া’ লিখা থাকত।
আজিজের মেয়ে মাকসুদা আজিজ জানান, ‘তবুও পোস্টম্যানের কাছ থেকে আমরা আমাদের ঠিকানায় সেই চিঠিগুলো পেতাম।’
ওই সময়টা তার বাবার জন্য কতটা কঠিন ও বিপজ্জনক ছিল সেই স্মৃতিও রোমন্থন করেন তিনি, ‘আমার বাবা ভ্যাসপা চালাতেন। প্রতিটি বড় খেলার আগে তিনি আমাদের স্কুল থেকে ছুটির আগেই বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন। সেটা একান্তই নিরাপত্তার খাতিরে। আমার বাবা প্রতিটি বড় খেলার আগে বিভিন্ন ধরনের হুমকিসহ অনেক বেনামী চিঠি পেতেন। রাতে আমাদের উপর হামলা করা হবে, আরও কত কী!’
রেফারি মোজাফফর হোসেন প্রায়শই বড় ম্যাচগুলোতে আজিজের দুজন সহকারীর (লাইন্সম্যান) একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি বুধবার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। বড় খেলার আগে তিনি সবসময় আমাদের সাহস দিয়ে বলতেন, ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরকে নিজেদের কাজ করতে হবে।’
যারা আজিজকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন, তাদের মধ্যে রেফারি রফিকুল ইসলাম অন্যতম। তিনি জানান, ‘আমি সর্বদা তার স্টাইল অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। যেমন- ফাউলের পরপরই দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া।’
তবে রফিক কখনোই গ্যালারি থেকে ছুঁড়ে মারা কোনো বস্তু আবার সেখানেই ফেরত পাঠানোর সাহস দেখাননি। অথচ আজিজ প্রায়ই তা করতেন নির্ভীক চিত্তে।
আজিজের সাহসিকতার নানা গল্প লোকমুখে আলোচিত হয়েছে। রেফারি মাহবুবুর রহমান মুকুল বলেন, ‘ময়মনসিংহে একটি খেলা পরিচালনার সময় ভক্তরা আক্রমণাত্মকভাবে তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। তবে হাতে পতাকা নিয়ে তিনি সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ছিলেন অটল। পাশাপাশি ফিফা রেফারি হিসেবেও তিনি গৌরবের সঙ্গে ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন এবং এমন অনেক ঘটনাও ঘটেছিল যেখানে তিনি সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে রেফারির ভুল সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছিলেন।’
আজিজ বাস্তবিকই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার আদর্শের অনুসারী ছিলেন বলেও জানান মুকুল। তিনি শুধু একজন রেফারিই ছিলেন না, ছিলেন খুব উঁচু মাপের সংগঠকও। অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ফুটবল ও ক্রিকেট দলকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে পালন করেছিলেন মূল ভূমিকা।
ব্যাংকার হওয়ার আগে ক্রীড়া ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবেও যে তিনি ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিলেন, তা সম্ভবত হাতেগোনা মানুষের জানা। দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট ও অভিষেক টেস্টের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল অবশ্য তাদের দলে নন। তার কাছে সেই স্মৃতি এখনও তরতাজা।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে আমিনুল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আজিজ স্যার গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আমাদের শারীরিক শিক্ষক ছিলেন। এটা ছিল আশির দশক এবং আমাদের বার্ষিক খেলাধুলা সেসময় সাত দিন ধরে চলত। তিনি ছিলেন আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে এবং আমার ভাইও তার সঙ্গে ছিলেন। ওখান থেকে আমাদের মতো অ্যাথলেটরা আত্মপ্রকাশ করেছিল। স্কুল ও এলাকার ওই ক্রীড়া কার্যক্রমগুলো মানসম্পন্ন ক্রীড়াবিদ তৈরির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।’
তিনি যোগ করেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে এসব এখন হারিয়ে গেছে। তার সততা তাকে সবার সম্মানের পাত্র করেছিল। তিনি সবসময় ছিলেন আমাদের পরিবারের বন্ধু। তার বিদায়ে দেশ একজন অসাধারণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে।’
Comments