রাইফেলের নামে সামরিক মানের অস্ত্র আমদানি, উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
যথাযথ মনিটরিং না থাকায় এক শ্রেণির লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবসায়ী রাইফেলের নামে আমদানি করছে সামরিক মানের আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
কাগজে রাইফেল হিসেবে উল্লেখ করে তারা পয়েন্ট ২২ বোরের আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বিক্রি করছেন লাইসেন্সধারী ক্রেতাদের কাছে। ‘উজি পিস্তল’ নামের এই অস্ত্রগুলো অনেকটা সাবমেশিনগানের মতো। রাইফেল বা পিস্তলের মতো নয়।
উজির ম্যাগাজিনে থাকে ২০টি গুলি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে যে পিস্তল থাকে সেখানে থাকে ১৫টি গুলি।
দেশে অস্ত্র আমদানিতে অনিয়ম সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এ তথ্য জানিয়েছে।
গতকাল এই প্রতিবেদনটি ডিএমপি ও পুলিশ সদরদপ্তরে জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের অস্ত্র জনগণের হাতে থাকলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
২০১৬ সালের অস্ত্র আইনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে স্বয়ংক্রিয় বা আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ।
যেভাবে উঠে এল বিষয়টি
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গত ২০ আগস্ট মিনাল শরিফ নামের এক মাদক চোরাকারবারিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার গাড়ি তল্লাশি করলে বিদেশি মদ ও লাইসেন্সকৃত পয়েন্ট ২২ বোরের একটি রাইফেল পাওয়া যায়।
তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে মিনাল এই অস্ত্রটি এক লাইসেন্সধারী ডিলারের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকায় কিনেছেন।
পরে, গোয়েন্দা পুলিশ এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়রি করে এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে সেই অস্ত্রটি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠায় মতামত নেওয়ার জন্যে।
ডিবি পুলিশের প্রতিবেদন মতে, অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের রাইফেলের লাইসেন্স দিয়ে আধা-স্বয়ংক্রিয় ‘উজি’ কেনা-বেচা সম্পূর্ণ অবৈধ বলে মত দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উজি পিস্তল হচ্ছে সামরিক মানের অস্ত্র। এ অস্ত্র বেলজিয়াম ও ইসরায়েলের সেনারা ব্যবহার করে। ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।’
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে এই প্রতিবেদনের একটি কপি রয়েছে।
অস্ত্র আমদানি
ডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে লাইসেন্সধারী অস্ত্রের ৮৪ জন ডিলারের মধ্যে মাত্র ১৪ জন ডিলার অস্ত্র বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি করে।
ডিবির চিঠির জবাবে ছয় জন ডিলার জানিয়েছেন, তারা ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাইফেলের নামে ৯১টি উজি আমদানি করেছেন। এর মধ্যে ৪৯টি অস্ত্র লাইসেন্সধারী বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
ছয় ডিলারের একটি ঢাকার পল্টনের মইন আর্মস কোং ২০টি উজি রাইফেল ও ১০টি উজি পিস্তল আমদানি করেছে। প্রতিবেদন মতে, পিস্তলগুলো এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী মইন ইকবাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘উজি পিস্তল এক ধরনের রাইফেল।’ তার মতে, রাইফেলের ছোট সংস্করণকে পিস্তল বলে।
অস্ত্রের গায়ে কেন ‘পিস্তল’ লেখা থাকে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা একটা ট্যাগ।’
তিনি বলেন, ‘যদি এই ব্যবসা আইনসম্মত না হয় তাহলে কাস্টমস বিভাগ অস্ত্রগুলো ছাড় দিল কিভাবে? আন্তর্জাতিক রপ্তানিকারকরা এই ব্যবসা করছে। আমরা ট্যাক্স দিই। আগ্নেয়াস্ত্র আমদানির সব নিয়মনীতি মেনে চলি।’
তার মতে, ‘পুলিশ মিথ্যা অভিযোগ করছে। এটি শুধু যে আমাদের ব্যবসা নষ্ট করবে তা নয়, আন্তর্জাতিক অস্ত্র রপ্তানিকারকদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দিবে।’
ঢাকার কাস্টমস ভ্যালুয়েশন ও ইন্টারনাল অডিট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার অরুণ কুমার বিশ্বাস ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যদি অস্ত্র আইন অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ হতো তাহলে সেগুলো হয়তো কোনোভাবেই দেশে ঢুকত না।’
এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ দ্রুত সব আমদানিকৃত ‘উজি পিস্তল’ বাজেয়াপ্ত করে সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়েছে। পুলিশের মতে, সেসব অস্ত্র যদি জঙ্গি বা অপরাধীদের হাতে যায় তাহলে বিপদের কারণ পারে।
পুলিশের প্রতিবেদনে পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, শুল্ক বিভাগ ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে কোনো অস্ত্র বিশেষজ্ঞ নেই বলে অস্ত্র আমদানিতে অনিয়ম হচ্ছে। তাই শুল্ক বিভাগে অস্ত্র ছাড় দেওয়ার সময় অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের উপস্থিত থাকা প্রয়োজন।
তেজগাঁও বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ইতোমধ্যে আধা-স্বয়ংক্রিয় উজি পিস্তল আমদানির বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
‘আমরা আমদানির বিষয়ে শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছেও চিঠি পাঠাব। আমরা এখন তদন্ত করছি কিভাবে এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো দেশে প্রবেশ করল এবং কারা এগুলো ব্যবহার করছেন।’
Comments