রাবিতে দুর্নীতি-অনিয়ম: ইউজিসি প্রতিবেদন দিলেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছে সরকার
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী এম জাকারিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে এখনো সরকারি পর্যায়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী এম জাকারিয়া ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও, শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ৩৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত শেষে সুপারিশসহ ২০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল রাবি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে একটি শীর্ষস্থানীয় ও বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠে এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইউজিসিকে তদন্ত করতে পাঠিয়েছিলাম। তদন্ত করেছে। সেটি আমরা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাব। এখনো বসিনি। বসে সিদ্ধান্ত জানাব।’
তবে, এখনো তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এসে পৌঁছায়নি বলে জানান তিনি। এ ছাড়াও, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় এখনো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়নি বলে জানান তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (সচিব) অফিসে যোগ দিলে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করব।’
তদন্ত প্রতিবেদন
তদন্ত শেষে রাবি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং আরও কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা মোট ২৫টি অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
এর মধ্যে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণে রাষ্ট্রপতিকে (আচার্য) অসত্য তথ্য দেওয়া, শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, নিয়ম ভেঙে বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং আর্থিক লেনদেনের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উপাচার্য ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে তার কন্যা ও জামাতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
এ ছাড়া, শিথিল করা এই নিয়মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে ৩৪ জন অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষকদের নিয়োগ নীতিমালা অসৎ উদ্দেশ্যে শিথিল করা হয়েছিল... অনেক যোগ্য প্রার্থীর জায়গায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
নীতিমালা শিথিল করার বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির এক সদস্য জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সিজিপিএ কমিয়ে নীতিমালা সংশোধন করেছে।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য এবং দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের উৎস অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে ইউজিসি। এ ছাড়া, তদন্তে সহযোগিতা না করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুল বারীকে অপসারণেরও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ৬২ জন শিক্ষক ও দুই জন চাকরিপ্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ইউজিসিতে দাখিল করে। অভিযোগপত্রে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
পরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অভিযোগগুলো তদন্তে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমকে আহ্বায়ক করে ইউজিসি একটি কমিটি গঠন করে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি উভয় পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপনে উন্মুক্ত শুনানিরও আয়োজন করে।
তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে সুপারিশসহ সর্বমোট ৭৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। যেখানে ৩৬ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন এবং ৭০০ পৃষ্ঠার সংযোজনী প্রতিবেদন রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ১৮ মাস ধরে নানা অজুহাতে দখলে রেখেছেন। উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বাড়ি ভাড়া বাবদ ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকা আদায়েরও সুপারিশ করা হয়েছে।
রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ইউজিসির ওই প্রতিবেদনকে ‘একপেশে ও পক্ষপাতমূলক’ বলে অভিযোগ করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের তোলা অভিযোগগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন তিনি। তিনি জানান, একদল লোক তাকে সরিয়ে দিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।
নিজের মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুসরণ করেই নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছিল।
উপ-শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে তদন্ত করা হলে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
আরও পড়ুন:
রাবি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি
Comments