করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ১৫ দফা সুপারিশ টিআইবির

করোনা মোকাবিলায় সরকারের কিছু কার্যক্রমে উন্নতি হলেও গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমে এখনো সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। স্বাস্থ্যখাতে গভীরভাবে বিস্তৃত দুর্নীতি করোনা সংকটে প্রকটভাবে উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি এই সংকটকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় সরকারের কিছু কার্যক্রমে উন্নতি হলেও গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমে এখনো সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। স্বাস্থ্যখাতে গভীরভাবে বিস্তৃত দুর্নীতি করোনা সংকটে প্রকটভাবে উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি এই সংকটকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।

এ ছাড়া, সরকারের সংকোচনমূলক নীতি প্রয়োগের (সেবা ও নমুনা পরীক্ষা হ্রাস) মাধ্যমে শনাক্তের সংখ্যা হ্রাস হওয়াকে ‘করোনা নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে দাবি এবং রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ- দ্বিতীয় পর্ব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

এসময় সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করে সংস্থাটি। তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। 

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন।

গবেষক দলের অপর সদস্যরা হলেন, একই বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম, মোরশেদা আক্তার, প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আকতার, এবং সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর ই খোদা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলম।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ১৫ জুন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রাক-সংক্রমণ প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে ও সংক্রমণকালে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল টিআইবি। যার ধারাবাহিকতায় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ২০২০ সালের ১৬ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। 

বর্তমান গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক আইন যথা করোনা মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এবং সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর কোনোটিই যথাযথভাবে এখনো অনুসরণ করা হচ্ছে না এবং করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের ক্রয়সহ সকল ক্রয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করা হয়নি।

গবেষণায় দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষাগার ও নমুনা পরীক্ষায় ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী একটি দেশে শনাক্তের হার মোট নমুনা পরীক্ষার পাঁচ শতাংশের বেশি হলে উক্ত দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে নির্দেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৬ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গড় শনাক্তের হার ছিল ১৭.৪% (সর্বোচ্চ ৩১.৯%)। ১৫ জুন-পরবর্তী সময়ে ‘কারিগরি পরামর্শক কমিটি’সহ বিশেষজ্ঞরা প্রতি দিনে ২৫-৩০ হাজার পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু পরীক্ষাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ১৫ জুন হতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ১৩ হাজার করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ২০তম অবস্থানে থাকলেও জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষার হারের দিক থেকে বাংলাদেশ অবস্থান বিশ্বে ১৬২তম। নমুনা পরীক্ষার বৈশ্বিক গড়ের (১০.৫%) চেয়ে বাংলাদেশ (১.৫%) এখনো অনেক পিছিয়ে।

গবেষণায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণে ঘাটতি এবং পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়নে ঘাটতি দেখা গেছে। বিভিন্ন দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় নতুন করে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করলেও, বাংলাদেশে কোভিডের জন্য নির্ধারিত কয়েকটি হাসপাতালে রোগী না থাকার কারণে চিকিৎসা কার্যক্রম বাতিল করে সাধারণ চিকিৎসা চালুর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। করোনা সংক্রমণের সঠিক চিত্র পেতে এবং দ্রুততার সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি চিহ্নিত করতে গত ৩ জুন কারিগরি পরামর্শ কমিটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য সুপারিশ করলেও, এখনো তা কার্যকর করা হয়নি।

বিভিন্ন সময় দেশে কোভিড চিকিৎসার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হয়। এমনকি বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে ইউরোপ আমেরিকার দেশসমূহের চিকিৎসা সেবার সঙ্গে তুলনা করা হলেও গবেষণায় দেখা যায়, এখনো বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি দেখা গেছে। সরকারি তথ্যমতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য সারাদেশে আইসিইউ শয্যার সংখ্যা মাত্র ৫৫০টি, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ৪৮০ বলা হলেও, এই সুবিধার অধিকাংশ ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। ১৫ জুন পরবর্তী সময়ে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট নয়। ১৫ জুন পরবর্তী সময়ে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতার ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও এখনো ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। এখনো জেলা পর্যায়ের দক্ষ জনবল (৪৮.৬%), প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (৫১.৪%) এবং নিরাপত্তা সামগ্রীর ঘাটতি (৩৬.২%) হাসপাতালগুলোতে রয়েছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত শতভাগ হাসপাতালে চিকিৎসক এবং ৮৯.১% হাসপাতালে নার্সের পদ শূন্য থাকলেও গত তিনমাসে ৫৬.৮% হাসপাতালে চিকিৎসক এবং ৪৮.৫% হাসপাতালে নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রোগী না থাকার কথা বলে কয়েকটি কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতাল ইতোমধ্যে বন্ধ করা হলেও জরিপে দেখা যায় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সেবাগ্রহীতাদের ৫.৪% অক্সিজেন সরবরাহ, ৩২.৪% ভেন্টিলেশন সেবা এবং ৩০.২% আইসিইউ শয্যা পায়নি।

গবেষণায় নমুনা পরীক্ষায়ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। যাচাই না করার ফলে লাইসেন্সবিহীন এবং ভুয়া হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা পরীক্ষা করার চুক্তি সম্পাদন করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন এলাকার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়। এভাবে এই প্রতিষ্ঠান সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

গবেষণা অনুযায়ী এখনো নমুনা পরীক্ষার ফল পেতে ৩৪.৪% সেবা গ্রহীতাকে তিন বা ততোধিক দিন প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়াও, জরিপে সেবাগ্রহীতাদের ৯.৯% নমুনা পরীক্ষায় ভুল প্রতিবেদন পাচ্ছেন। যথাসময়ে প্রতিবেদন না পাওয়ায় অনেক প্রবাসীর কর্মক্ষেত্রে ফেরার ক্ষেত্রে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, অনেক কষ্টে জোগাড় করা ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। এ ছাড়া, কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া প্রতিবেদন নিয়ে ভ্রমণ করায় ছয়-সাতটি দেশে বাংলাদেশিদের গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং যাত্রীদের ফেরত পাঠানো হয়।

গবেষণায় জুন মাস পরবর্তী সময়েও করোনা সংকট মোকাবিলায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখা গেছে। জরুরি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ লঙ্ঘন করে বিভিন্ন প্রকল্পে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি ব্যবহার করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেক ক্ষেত্রে মৌখিক আদেশে ক্রয় করা হয়েছে এবং কোনো ক্রয়ে ই-জিপি মাধ্যম ব্যবহার করা হয়নি। কয়েকটি সিন্ডিকেট কর্তৃক স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের ক্রয় নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে, যার সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, বিভিন্ন হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ দুদকের কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও পাওয়া যায়।

গবেষণায় হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা, হাসপাতালে মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ বিস্তার রোধে কার্যকরতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া, করোনা সংক্রমণ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশে ঘাটতি ও মতপ্রকাশে বিধি-নিষেধ দেখা যায়। সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি দাবি করে অধিদপ্তর হতে টেলিভিশনে প্রচারিত নিয়মিত বুলেটিনটি ১২ আগস্ট থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮ আগস্ট সরকারি কর্মচারী কর্তৃক গণমাধ্যমে করোনা বিষয়ক তথ্য ও মতামত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিপরীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ব্যবহার করোনাকালে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্টিকেল-১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত) ২৯১ জনের বিরুদ্ধে মোট ১৪৫টি মামলা করা হয়। যার মধ্যে ৬০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা করা হয় এবং ৩০ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিজিটাল আইনে হওয়া মামলাগুলোর তিন-চতুর্থাংশের বেশি সরকার, সরকারি দলের লোকজন এবং সরকারের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্যের অভিযোগের প্রেক্ষিতে করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, এই নয় মাসে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নিয়ে সমালোচনাধর্মী সংবাদ প্রকাশের কারণে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমের ১০ জন সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

গবেষণায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অনিয়ম-দুর্নীতি লক্ষ্য করা গেছে। জরিপে নগদ সহায়তা উপকারভোগীদের ১২% তালিকাভুক্ত হতে এবং নগদ সহায়তায় উপকারভোগীদের ৫৬% সহায়তা পেতে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। করোনাকালে যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুনীতির প্রমাণ মিলেছে, তাদের ৯০ জনই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল। করোনাকালে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে এ পর্যন্ত শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত করে। তবে জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই (অন্তত ৩০ জন) উচ্চ আদালতে রিটের মাধ্যমে স্বপদে ফিরে এসেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণে বৈষম্য ও দুর্নীতি হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ করোনাকালে সরকারের প্রণোদনা সহায়তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা ও সমতলে সাঁওতালসহ অন্য জাতিগোষ্ঠীর মাত্র চার হাজার ১০০টি উপকারভোগী পরিবার (মোট পরিবারের ২৫%) সরকারি সুবিধা পেয়েছে। করোনাকালে দেশের সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পাঁচ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। করোনাকালে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বেতনভোগী কর্মজীবীদের ৭২% চাকরি হারিয়েছেন কিংবা কর্মক্ষেত্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি সেবা দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত সারাদেশে সাত হাজার ২৪৯ জন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১০০ জন চিকিৎসক ও ১০ জন নার্স মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ৯ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জন্য ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা বা বিশেষ সম্মানী (দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ এককালীন প্রদান) চার মাস অতিবাহিত হলেও দেওয়া হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় জাতীয় এবং স্থানীয় উভয় পর্যায়েই সুশাসনের সবগুলো নির্দেশকেই ব্যত্যয় ঘটেছে এবং ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। যে ঘাটতি বা ব্যত্যয়গুলোর অধিকাংশই মানবসৃষ্ট। করোনাভাইরাসের এই সংকট এবং সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাত যে চাপের মধ্যে পড়েছে, এ দুইয়ের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির সুবিধাভোগী এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিবর্গ দুর্নীতির মহোৎসবে নেমেছে। ফলে ব্যাপক দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার কোন দৃষ্টান্ত যেমন ছিল না, তেমনি কোনো নিয়ন্ত্রণ, তদারকিও ছিল না বললেই চলে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের অংশ হিসেবে কেবলমাত্র বদলি এবং ওএসডি নির্ভর এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা দেখা গেছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নমুনা আমরা দেখতে পাইনি। দুদক কিছুটা সক্রিয় হলেও নিজস্ব এক ধরনের সীমারেখার ভিতরেই তারা বিচরণ করছে। ফলে যারা দুর্নীতির তথাকথিত রুই-কাতলা, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে, শুধু সামনের সারিতে থাকা কিছু ব্যক্তিকে টানাহেঁচড়া করা হয়েছে। যখন স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং জাতীয় পর্যায়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে, তখন স্বাস্থ্য বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই সময়কালে একটি বৈঠকও করেনি। তারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। হয়তো এর মধ্যে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং দুর্নীতি যারা করেন, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থাকতে পারে।’ 

করোনার এই সংকটে তথ্যের নিয়ন্ত্রণে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই দেখতে পাই যে, সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলার বদলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখাটাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে এবং এক ধরনের সংকোচনমূলক নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে, তথ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, টেস্ট নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্যখাতে জনগণের অভিগম্যতা কমে গেছে। শনাক্তের সংখ্যা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সাফল্যেও দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দেখা গেছে। সরকার দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণে যতটা তৎপর, তার চেয়ে বেশি তৎপর ছিল তথ্যের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং আমাদের সংবিধানের সাংঘর্ষিক।’

এমসয় তিনি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘শীত মৌসুমে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে প্রধানমন্ত্রী সতর্কবার্তা দিলেও, বাস্তবে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘোষণা ছাড়া সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার বিষয়ে আমরা পর্যাপ্ত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা কৌশল দেখতে পাই না।’

এই গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি আইনের শাসন, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, অংশগ্রহণ ও সমন্বয় এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এই চারটি বিষয়ের অধীনে ১৫ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের ক্রয়ে সরকারি ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করতে হবে, করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য দ্বিতীয় পর্যায়ের আঘাত মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা সব জেলায় সম্প্রসারণ করতে হবে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালের সেবাসমূহকে (আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি) করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে, দেশজুড়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে নিয়মিত সভা করতে হবে এবং করোনায় সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, করোনা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে যে বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে তা বাতিল করতে হবে, গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সরকারি ক্রয়, করোনা সংক্রমণের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, ত্রাণ ও প্রণোদনা বরাদ্দ ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা সংশোধন করতে হবে এবং হয়রানিমূলক সব মামলা তুলে নিতে হবে, বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই-বাছাই ও হালনাগাদ করতে হবে এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে, স্বাস্থ্যখাতে ক্রয়ে তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে এবং অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সাময়িক বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ মামলা পরিচালনা করতে হবে। এসব জনপ্রতিনিধিদের পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা বাতিল ঘোষণা করতে হবে, সম্মুখসারির সব স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য প্রণোদনা দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

Comments