‘এক লাখ টাকায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা করা সম্ভব’

সেমিনারে কথা বলছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

আমাদের দেশের দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও নারীর প্রতি অবহেলা— এই তিনটি কারণে সেরিব্রাল পালসির বিস্তৃতি বাংলাদেশ বেশি বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

গতকাল শনিবার দুপুরে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে সেরিব্রাল পালসির সার্জিকেল চিকিৎসা সংক্রান্ত সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন বলে আজ দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘পুষ্টিহীনতা ও বাচ্চা হওয়ার সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পাওয়া। এ দুটি সমস্যার কারণে এ রোগটি হয়েও যেতে পারে। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে এটি প্রতিরোধ করা। যদি রোগটি হয়ে যায়, তাহলে সার্জিকেল অপারেশন করা। সার্জিকেল অপারেশনে এ রোগ ভালো হয়। চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অপারেশনে তিন থেকে চার লাখ টাকা নেয়। কিন্তু, আমরা এক লাখ টাকায় এ চিকিৎসা দিচ্ছি।’

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী। সে সময় আরেও বক্তব্য রাখেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরো সার্জন ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোস্তফা মাহবুব, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার নাজমুল হক, শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মেজবা উদ্দিন আহমেদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. কণা চৌধুরী প্রমুখ।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, ফেসিয়াল পালসির অর্থ হলো ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস (মুখ বেঁকে যায়, চোখ খোলা থাকে)। সেরিব্রাল পালসিও ওই রকম একটা রোগ। যেখানে ব্রেইনের কিছু কিছু অংশ নষ্ট হতে থাকে বা নষ্ট হয়। সোজা কথায় সেরিব্রাল পালসি মানে আমরা বলতে পারি আংশিক ব্রেইন প্যারালাইসিস। সাধারণত জন্মের পর পর নবজাতক ভালোভাবে নিশ্বাস নিতে না পারার জন্য শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এই অক্সিজেন স্বল্পতাই সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রেইন। আমাদের দেশে এক হাজার বাচ্চা জন্মগ্রহণ করলে তারমধ্যে সাড়ে তিন জন বাচ্চাই সেরিব্রাল পালসিতে  আক্রান্ত হয়। যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় দেড় গুণ বেশি।

সেমিনারের অন্যান্য বক্তারা।

তারা বলেন, এই সব রোগীদের অধিকাংশের খিঁচুনি হয়। যখন খিঁচুনি হয়, তখন বাচ্চা নিশ্বাস নিতে পারে না। এভাবে বারবার খিঁচুনি হলে ব্রেইনে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে ব্রেইন বারবার ক্ষতি হতে পারে। এসব বাচ্চাগুলো হাঁটা-চলাফেরা করতে পারে না, ঘাড় শক্ত করতে পারে না, পরিবারের সবার সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারে না, মুখ দিয়ে লালা পড়ে, বাচ্চা শক্ত খাবার খেতে পারে না, রোগ যখন তীব্র হয় তখন বাচ্চা তরল খাবারও খাইতে পারে না। অনেক বাচ্চা কথাও বলতে পারে না, অনেক রোগী চোখে দেখে না, অনেক রোগীর হাত-পা শক্ত হয়ে যায় এবং এরা নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারে না। সব রোগীর ক্ষেত্রে সবগুলো লক্ষণ থাকবে, তা কিন্তু নয়।

‘এসব বাচ্চাদের মাথার খুলি ছোট থাকে। তাদের মাথার খুলি ছোট হওয়ার কারণে ব্রেইনের পর্দাও ছোট থাকে। মাথার খুলি যেহেতু বাড়ে না, কারণ মাথার জোড়াগুলো এক বছরের পূর্বে সম্পূর্ণ জোড়া লেগে যায়। যার ফলে ব্রেইন পূর্ণতা লাভের জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়তে হবে, তা আর সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় মাথার খুলি কেটে ব্রেইনের পর্দা কেটে প্লাস্টিক সার্জারি করে দিলে ব্রেইন বাড়ার যথেষ্ট জায়গা পায়। যার ফলে দ্রুত ব্রেইন বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণতা লাভ করে এবং অন্যান্য উপসর্গ লোপ পায়।’

সেরিব্রাল পালসির পাঁচটি কারণ বলা হয়েছে। সেগুলো হলো— জন্মকালে ব্রেইনে অক্সিজেন স্বল্পতা; ব্রেইনে সংক্রামণ; ২৮ সপ্তাহের পূর্বে বাচ্চার জন্মগ্রহণ; জন্মের পর অল্প ওজন থাকা ও গর্ভাবস্থায় ভাইরাস সংক্রম।

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত অপারেশন পদ্ধতির বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রোগীকে অজ্ঞান করে কানের এক পাশ থেকে অপর পাশ পর্যন্ত কেটে মাথার চামড়া পুরোটুকু কেটে মাথার খুলিকে উন্মুক্ত করা হয়। তারপর মাথার খুলির দুই পাশ কেটে নেওয়া হয়। এরপর মাথার খুলির প্লাস্টিক সার্জারি করে পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হয়। কিন্তু, তার আগে মাথার খুলি যখন অপারেশন করা হয়, তখন ব্রেইনের পর্দা বা আবরণ বা ডুরামিটার কেটে আর্টিফিশিয়াল পর্দা লাগিয়ে দেওয়া হয়। যাতে ব্রেইন বাড়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা পায়। পরবর্তীতে সবকিছু জায়গামতো প্রতিস্থাপন করে চামড়া সেলাই করে দেওয়া হয়।

সেরিব্রাল পালসির প্রচলিত চিকিৎসার বিষয়ে বলা হয়েছে, সাধারণত উন্নত বিশ্বে অনেক স্পেশালিস্ট নিয়ে যেমন: নিউরো সার্জন, নিউরো মেডিসিন, ফিজিকেল মেডিসিন, সাইক্রিয়াট্রিস্ট, অর্থপেডিক সার্জন— সবাই মিলে একটা টিম গঠন করে একটা চিকিৎসা দেয়। যেসব মেডিসিন ব্যবহার করা হয়, তা হলো— অ্যান্ট্রিইনফ্লেমেটরি,  খিঁচুনি বন্ধ হওয়ার ওষুধ, বেঞ্জোডাইয়াজিপিন, বেকক্লোফেন, ডেনট্রোলিন, গাবাপেনটিন, কাবিডোপা-লিবোডোপা ও বেঞ্জট্রপিন। ইনজেকটেবল ফরমে দেওয়া হয়— বটোলিনিয়াম টক্সিন এবং সঙ্গে ফিজিও থেরাপিও দেওয়া হয়। সার্জারি যেটা করা হয়, তা হলো— বেক্লোফেন পাম্প, সিলেক্টিভ ডরসাল রিহাইজোটমি, টেনডোম রিলিজ, হিপ রোটেশন সার্জারি, স্পাইল ফিউশন, স্ট্রেবিসমাস রিপিয়ার, ডিপ ব্রেইন এসটিমুলেশন (ডিবিএস)।

পরিশেষে বলা হয়েছে, মাথার খুলি ও ব্রেইনের পর্দা প্লাস্টিক সার্জারি করে এসব রোগীরা ভালো হচ্ছে। তাই এই মৃত্যু পথযাত্রী বাচ্চাগুলোকে অপারেশনের মাধ্যমে বাঁচানোর জন্য গণস্বাস্থ্য নিউরো সায়েন্স সেন্টারের পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
NCP protest rally for election commission reform

NCP to hold protest rally in front of EC demanding its reconstitution

Calls on govt to hold local elections without delay

1h ago