কোভিড-১৯ ও এশিয়ার এক হারানো প্রজন্ম

আগামী দুই বছরে নিজের জীবন বদলে দেওয়ার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন ভারতের বিহার রাজ্যের ২৫ বছরের বিকাশ কুমার। মুম্বাইয়ে সাত বছর দর্জির কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। মহামারি আসার আগ পর্যন্ত মাসে প্রায় ২৫ হাজার রুপি আয় ছিল। অন্যের কারখানায় কাজ ছেড়ে দিয়ে ছোট পরিসরে নিজের ব্যবসা শুরু করার ভাবনা ছিল বিকাশের।

কর্মস্থল মুম্বাই থেকে প্রায় ১৭ শ কিলোমিটার দূরে মাটির বাড়িতে থাকেন বিকাশের বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানের পরিবার। ইচ্ছা ছিল জমানো টাকা দিয়ে ইটের পাকা বাড়ি করার। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছে।

মহামারি ঠেকাতে ভারত সরকার মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা করলে কাজ বন্ধ হয়ে যায় বিকাশের। কর্মহীন অবস্থায় পরের দুই মাস মুম্বাইয়ে বসে কাটিয়েছেন। পরিস্থিতির উত্তরণ না হওয়ায় মে মাসে বিহারে ফিরে আসেন বিকাশ। এই সময়ের মধ্যে সঞ্চয়ের এক লাখ রুপি খরচ হয়ে গেছে পরিবারের ভরণপোষণে। মুম্বাইয়ে যে কারখানায় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন সেটি আংশিকভাবে চালু হলেও বিকাশ বুঝতে পারছেন না ফিরে গিয়ে যথেষ্ট আয় করতে পারবেন কি না। বাড়িতে যে কৃষিকাজ করবেন সেই উপায়ও নেই, কারণ কোনও জমি নেই তার।

বিকাশের ভাষায়, ‘এই বছরটা বেকার চলে গেল।’ আগামী বছরের ভাগ্যে কী আছে এখন সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ঘেরা বিকাশের জীবনের গল্প এই মহামারির মধ্যে একটি উদাহরণ মাত্র। এশিয়াজুড়ে তার মতো আরও বহু তরুণ এই অনিশ্চিয়তার ঘেরাটোপে আটকে রয়েছেন। হারিয়ে যেতে বসেছে পুরো একটি প্রজন্ম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নজিরবিহীন এই পরিস্থিতিতে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, সামাজিক এমনকি মনস্তাত্ত্বিকভাবেও তরুণদের ওপর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সামাজিক দূরত্বের অভিঘাত শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যেই পড়েনি, এতে তরুণরা মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছেন। ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা।

বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, অন্য যেকোনও বয়সীদের তুলনায় ২৪ বছরের কম বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই সময়টায়। এর মধ্যেও যারা কাজ পাচ্ছে তাদের মজুরি খুবই কম। আইএলও বলছে, ভবিষ্যতে মন্দা কেটে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন কম মজুরির কারণে তরুণদের ভুগতে হবে।

তরুণদের জীবনে মহামারির প্রভাব সম্পর্কে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফ্যামিলি অ্যান্ড পপুলেশন রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক জিন ইউং বলেন, তরুণ প্রজন্মের জীবনের ভবিষ্যৎ গতিপথ বদলে দিতে পারে এই মহামারি।

তরুণদের চাকরিতে প্রবেশের পথ মসৃণ না হলে জীবনের পরবর্তী বড় ঘটনা যেমন: বিয়ে, সন্তান জন্মদান ও নিজের বাড়িতে স্থায়ী হওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

তার ভাষায়, ‘এই সংকট যত দীর্ঘ হবে এ থেকে উত্তরণের পথও তত বন্ধুর হবে। প্রয়োজনীয় সহায়তা না পেলে পুরো একটি প্রজন্মই হারিয়ে যেতে পারে।’

এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশ জাপানে এখন এই আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয় সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের প্রয়োজনীয় সহায়তা না দেওয়া হলে গত শতাব্দীর আশির দশকের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যখন গৃহনির্মাণ শিল্পে হঠাৎ ধস নামায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

২০২০ সালে জাপানে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০ হাজার জন চাকরি নিশ্চিত না করে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে আগামী বছর এই সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যাবে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বেকারত্ব নিয়ে গত আগস্টে প্রকাশিত আইএলও’র প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালের শেষ ত্রৈমাসিক থেকে হংকং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে ২৪ বছরের কম বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধির এই হার চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকেও অব্যাহত ছিল। ২৫ বছরের বেশি বয়সীদের সঙ্গে তুলনায় কম বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব দ্রুত বেড়েছে এই সময়টায়।

আইএলও বলছে, কোভিড-১৯ মহামারিতে যেসব সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সেক্টরগুলোতেই তরুণদের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রতি দুই জন তরুণের মধ্যে এক জনের চাকরিতে মহামারির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাজীবন শেষ করে যারা নতুন শ্রমবাজারে ঢুকছেন তাদের অস্থায়ী চাকরির পেছনে ছুটতে হচ্ছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, মহামারির কারণে উচ্চ আয়ের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেলেও দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ উপকরণ অনেকের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় পরিবার পরিকল্পনার বাইরে লাখো শিশু জন্ম নিতে পারে।

জাপানের তথ্য বলছে, গত মে থেকে জুনে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গর্ভধারণ কমেছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। মানুষের আয়ের ওপর কোভিড-১৯ এর কুপ্রভাবের কারণে এমনটা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে গত ৩ থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় এক হাজার ৭৫৪ জন বিবাহিত নারীর ওপর পরিচালিত জরিপে অন্তঃসত্ত্বা পাওয়া যায় ৭৭ শতাংশকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নশীল বিশ্বে জন্মহার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক বৈষম্যও বাড়তে পারে। আর জাপান, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে নিম্ন জন্মহারের কারণে শ্রম সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হবে।

Comments

The Daily Star  | English

US strikes on Iran: what you need to know

Trump said the United States struck three main Iranian nuclear sites: Fordo, Natanz and Isfahan, with the former being hit with a "full payload of bombs."

50m ago