তারা কি ফিরিবে আর সুপ্রভাতে…
“তিনি ছিলেন এক ভয়ংকর খুনে বাহিনীর নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন তিনি তার খুনে আল-বদর বাহিনীকে লেলিয়ে দেন। তার নীলনকশা অনুসারে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় আল-বদররা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করে।”
এটা আমার কথা নয়, যুদ্ধাপরাধ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যখন আল-বদর বাহিনীর প্রধান এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় দেয়া হয়, সে রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ ৫০ বছরেও তার মেধাবী সন্তানদের গুরুত্ব না বুঝলেও, পাকিস্তানিরা বুঝেছিল মাত্র ৯ মাসেই। একটু ভুল বলা হলো, তাদের বোঝানো হয়েছিল। এবং সেটা করেছিল আমাদেরই ঘৃণ্য স্বজাতি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে হত্যার মূল কাজটি করেছিল আল-বদর বাহিনী।
পাকিস্তানি লেখক সেলিম মনসুর খালিদ প্রণীত উর্দু গ্রন্থ ’আল-বদর’ প্রকাশিত হয়েছিল লাহোর থেকে ১৯৮৫ সালে। এই বইয়ে আল-বদরপ্রধান, তাদের সহকারী ও অন্য সদস্যদের বিভিন্ন ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। যেটি পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আদালতে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত।
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী মিলিশিয়া হিসেবে গঠিত হয়েছিল আল-বদর বাহিনী। যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ইঙ্গিত যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির দিকে। কারণ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ’পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ’ বই থেকে জানা যায় যে, স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে মি. আলীর স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়।
পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকেই বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে, আর সেটায় ফাইনাল টাচ দেয় ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে। এটি কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়, পরিকল্পিত গণহত্যা বা জেনোসাইড। কারণ, গণহত্যার ইংরেজি হিসেবে সাধারণত ‘জেনোসাইড’ (Genocide) বা ‘ম্যাস কিলিং’ (Mass Killing) ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, শব্দ দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হলো ‘ম্যাস কিলিং’ বা ‘ম্যাস মার্ডার’। আর বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞকে বলা হয় ‘জেনোসাইড’। পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মগজে আঘাত করে যাতে স্বাধীন একটি দেশ সহসা ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
অথচ, মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচার করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বারবার ক্ষমা চাওয়ার কথা বললেও পাকিস্তান সেটি এড়িয়ে গেছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অন্যতম দুই হোতা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান স্বাধীনতার পরপরই বিদেশে পালিয়ে যান। চ্যানেল ফোর নির্মিত ডকুমেন্টারির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, আসামি চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে বহাল তবিয়তে বসবাস করছেন। আশরাফুজ্জামান আছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
বাইরের দেশ থেকে আসামি নিয়ে এসে সাজা দেয়াটা জটিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া। সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের হাতে এর অনেকটাই নেই। তবে, আমাদের হাতে যেটি আছে সেটি হলো – শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ও তাদের পরিবারকে সম্মান জানানো। সম্মান জানাতে হলে প্রয়োজন একটি সঠিক তালিকা।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রণয়ণ তো দূরের কথা, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাই ঠিক করতে পারিনি। একেক জায়গায় একেক তথ্য, একেক তালিকা।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন মুক্তিযুদ্ধের পরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু, সেটি বেশিদূর এগোয়নি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী নিয়ে প্রণিধানযোগ্য কাজ বলতে গেলে যে দুটি গ্রন্থের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে সেগুলি হলো- ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ,’ (১৯৮৪) এবং ’শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ (১৯৮৫)। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থই সম্পাদনা করেছেন একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক রশীদ হায়দার।
এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ হয়েছে – জেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশাজীবী কেন্দ্রিক শহীদ বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে, যার প্রায় সবগুলিই বেসরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে করা। কিন্তু, এর কোনটাই সম্পূর্ণ নয়।
আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এবং আলী মো. আবু নাঈম ও ফাহিমা কানিজ লাভা কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষে আছে ৪৭৭ জনের নাম।
আবার বাংলাপিডিয়ায় মুয়াযযম হুসায়ন খানের দেয়া তথ্য অনুসারে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১১১১ জন। তাদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪২ জন আইনজীবী, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন।
অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী দিবসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দিবসের অনুষ্ঠানে মাত্র ৬১ শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারকে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ পাঠানো হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নিয়ে এই জগাখিচুড়ি অবস্থা তাদের প্রতি অসম্মান ছাড়া আর কী বলবো? অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ের লাশ পর্যন্ত পায়নি।
কথা হচ্ছিলো একুশে ফেব্রুয়ারি গানের সুরকার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের সাথে। তিনি জানালেন, বাবার লাশটাও পাননি তারা। পরে, শহীদ মিনারে বাবার স্মরণে একটি গাছ লাগিয়েছেন। সেটিকেই বাবার স্মৃতি মনে করে গাছের পাশে বসে থাকেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় যে বাড়িটায় থাকতেন বাড়ির গলির সেই রাস্তার নামকরণ একজন জীবিত রাজনীতিবিদের নামে কীভাবে হয়?
কেন সেলিনা পারভীনের সন্তান সুমন জাহিদকে আত্মহত্যা করতে হয় বা অপমৃত্যুর দায় নিতে হয়?
এর উত্তর কার কাছে আছে?
শহীদ বুদ্ধিজীবী ও তাদের পরিবারের পক্ষে চিৎকার কেন অর্থহীন আর্তনাদ হয়ে ওঠে? তাদের যথাযথ সম্মানের কথা কেন এতো দুর্বোধ্য ভাষা হয়ে ওঠে?
আশার কথা হলো, গত ১৯ নভেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ ও তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে এই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির একজন সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, প্রথম সভায় আলোচনা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে। এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়া এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষের দেয়া সংজ্ঞার আলোকে এ সংজ্ঞা নির্ধারণ হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে সভায় সদস্যরা একমত হন।
এরপরে সভায় আলোচিত হয় বুদ্ধিজীবীর তালিকা নিয়ে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের নামের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে কমিটি।
প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় ১৯৭২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ১০৭০ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক ডাক টিকিটের ১৫২ জনের সমন্বয়ে তৈরি হবে প্রাথমিক তালিকা। তথ্যমন্ত্রণালয়ের তালিকায় যে ১০৭০ জন আছেন, তাদের অনেকেই আবার স্মারক ডাক টিকিটেও আছেন।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকার কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্য যাচাই বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করবে কমিটি।
আলতাফ মাহমুদ, ডা. আলীম চৌধুরী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কবি মেহেরুনেচ্ছা, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, চট্টগ্রামের নূতনচন্দ্র সিংহ, সাধনা ঔষধালয়ের যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, ড. জি সি দেব, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন, শহীদুল্লা কায়সার বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—হবিবর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আবদুল কাইয়ুম কী পরিমাণ মেধাবী ছিলেন এবং তাদের হত্যাকাণ্ডে দেশ কয়শো বছর পিছিয়েছে সেটি নিয়ে তুলনামূলক সামাজিক আলোচনা আমার লেখার উদ্দেশ্য না। প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অনেক সভা-সেমিনার হয়। অনেক চোখের পানি খরচ হয়। আমরাও একদিনের জন্য মুখোশ পরে মিশে যাই দুঃখ স্রোতে। তারপর ধীরে ফিকে হয়ে যায় তাদের অস্তিত্ব।
অবশ্য আমাদের দোষ দিয়েই বা কী লাভ? যারা জাতিকে অগ্রসর চিন্তা শেখাবেন, মননে সমৃদ্ধ করবেন, তাদের একটা বড় অংশকেই তো হত্যা করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসেও কষ্ট নিয়ে বলতে হচ্ছে, যুদ্ধে পরাজিত হয়েও জাতির মনন ধ্বংসের পরিকল্পনায় পাকিস্তানি বাহিনী জয় লাভ করেছে। তা না হলে ২০২০ সালে এসে শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে এতো অশ্রদ্ধা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় অনলাইনে ও অফলাইনে নারীর প্রতি এতো অসম্মান, সম্ভব নয় মৌলবাদের এতো তীব্র হুংকার। সম্ভব নয় বাউলদের চুল কেটে দেয়া, ভাস্কর্য বা মূর্তি ভাঙা।
মুক্তিযুদ্ধে নাম জানা বা না জানা সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। সেই সাথে আশা করছি দ্রুততম সময়ে তাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন হবে এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার সহানুভূতি নয়, তাদের নায্য সম্মান পাবেন।
লেখক: সাবেক প্রধান নির্বাহী, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, কো-ফাউন্ডার, জাহাজী লি.
Comments