অযত্নে হারিয়ে যাচ্ছে নোয়াখালীর বধ্যভূমি

মহান মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী স্থানীয় রাজাকার, আলবদরের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে জীবন দিয়েছিলেন নোয়াখালীর অসংখ্য তরুণ, শিক্ষক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। তাদের নির্মমতা থেকে রক্ষা পাননি এ অঞ্চলের নারীরাও।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী পৌর এলাকার কালাপুলের উত্তর পাশে মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা করে মরদেহ খালে ভাসিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ছবি: স্টার

মহান মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী স্থানীয় রাজাকার, আলবদরের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে জীবন দিয়েছিলেন নোয়াখালীর অসংখ্য তরুণ, শিক্ষক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। তাদের নির্মমতা থেকে রক্ষা পাননি এ অঞ্চলের নারীরাও।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী জেলার বেগমগঞ্জ ও সদর উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো। তবে, জেলায় ঠিক কতটি বধ্যভূমি আছে তার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।

আটটি বধ্যভূমির তথ্য মুক্তিযোদ্ধারা দিলেও অনেকগুলোর হিসাব ও চিহ্ন নেই। এই আট বধ্যভূমির মধ্যে সবগুলো সংরক্ষণ করাও হয়নি। বধ্যভূমিতে সমাহিত শহীদদের সংখ্যাও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না নোয়াখালী জেলা ও বেগমগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা।

এসব বধ্যভূমি যথাযথ সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে, বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দেশের সূর্য সন্তানদের স্মৃতি ধরে রাখতে জেলার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন জেলার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও সাধারণ মানুষ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌর এলাকার কালাপুলের উত্তর পাশে, বেগমগঞ্জের আলীপুরের আটিয়া বাড়ি পুলের কাছে, বেগমগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল হাইস্কুলের পশ্চিম পাশে, বেগমগঞ্জ দিঘীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় সিএন্ডবি অফিস সংলগ্ন, সদর উপজেলার নোয়াখালী পৌরসভার সোনাপুর আহম্মদিয়া হাইস্কুল ক্যাম্পাস, বেগমগঞ্জ বাংলাবাজার, মাইজদী কোর্ট রেল স্টেশনের দক্ষিণে ও নোয়াখালী সদর হাসপাতাল (বর্তমানে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল) প্রাঙ্গণের পূর্ব-দক্ষিণে একটি করে বধ্যভূমি আছে।

এই আট বধ্যভূমির তিনটিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় সেগুলো বিনষ্ট ও বিলুপ্তির পথে।

বেগমগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল হোসেন বাঙালি ও উত্তর নাজিরপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল করিম প্রকাশ চৌধুরী (৭২) দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১ রমজান সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন ইফতার করতে বসেছিলেন। সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১১১ জনকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে বেগমগঞ্জের কালাপুলের উত্তর পাশে জড়ো করে। এরপর কালাপুলের ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় কারিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করে অনেককে পুলের নিচে ওয়াপদা খালে ফেলে দেয়।

তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জনের মরদেহ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন তারা।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল হোসেন বাঙালির মন্তব্য, ‘বর্তমান সরকার বেগমগঞ্জের কালাপুলের কাছে জেলা পরিষদের উদ্যোগে “একাত্তরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ” স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করলেও যথাযথ যত্ন না থাকায় এটি সন্ধ্যার পর স্থানীয় বখাটেদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বধ্যভূমি এলাকার একাধিক ব্যক্তি ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে বখাটেরা মাদকসেবন করতে আসে। ভয়ে কেউ তাদের বাধা দেন না।

প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর আসার ৩ থেকে ৪ দিন আগে স্মৃতিসৌধটি পরিষ্কার-পরিছন্ন করা হয় উল্লেখ করে তারা আরও জানিয়েছেন, ১৬ ডিসেম্বরের পরে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে আবার বখাটেদের আড্ডা বসে।

তারা স্মৃতিসৌধটি রক্ষণাবেক্ষণের দাবিও জানিয়েছেন।

নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মমতাজুল করিম বাচ্চু (৭৮) ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৫ জুন সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে শতাধিক মুক্তিকামী তরুণ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের ধরে সোনাপুর আহম্মদিয়া হাইস্কুলের মাঠে এনে হত্যা করে কবর দেয় হানাদার বাহিনী। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্কুল প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘মাইজদী রেল স্টেশনের দক্ষিণে ৩০ থেকে ৪০ জনকে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়। এছাড়াও, চৌমুহনীর বাংলাবাজার এলাকায় বধ্যভূমিতে দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে এনে হত্যা করা হয়।’

‘কিন্তু, সেখানে কোনো ফলক নির্মাণ করা হয়নি,’ যোগ করেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোশারেফ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘যুদ্ধ চলাকালে আমি সদর উপজেলার “সি” জোনের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলাম। নোয়াখালী সদর হাসপাতাল ক্যাম্পাসের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে (পুরাতন লাশ কাটা ঘর সংলগ্ন এলাকা) একটি বধ্যভূমি আছে।’

বলেছেন, ‘বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ না করায় এর ওপরে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া নোয়াখালীর সূর্য সন্তানদের স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।’

বেগমগঞ্জের নাজিরপুর গ্রামের যুদ্ধাহত তৈয়বা খাতুন (৭৫) ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমার বাড়ি বেগমগঞ্জের কালাপুলের কাছে। যুদ্ধ শুরু হলে ভয়ে আমার স্বামী লাতু মিয়া ও বড় ছেলে গোলাম মাওলাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে গ্রামের পশ্চিম পাশে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে গিয়েও তাদের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে আমার স্বামীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। তার বাম পায়ে গুলি লাগে। স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক ডা. বিজেন্দ্রলাল বাবু তার চিকিৎসা করেন।’

তৈয়বা খাতুন যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমি আড়াল থেকে দেখেছি হানাদার বাহিনী কীভাবে নোয়াখালীর মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে কালাপুলের ওপর গুলি করে হত্যা করে মরদেহ খালে ভাসিয়ে দিয়েছে।’

বেগমগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল হাইস্কুলের সামনে বধ্যভূমিতে জেলা পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হলেও এটি এখনো জনসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হয়নি।

নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিলন ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবি দাবিই রয়ে গেছে।’

জেলার বধ্যভূমিগুলোর চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণসহ একজন করে নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগের দাবিও জানিয়েছেন তিনি।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. খোরশেদ আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জেলায় বধ্যভূমির সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি।

বেগমগঞ্জে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলিত থাকার বিষয়ে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে খুব শিগগির বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘এছাড়াও, বাকি বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গণপূর্ত অধিদপ্তর কাজ করছে।’

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

7m ago