অপারেশন খরচাখাতা: প্রতারণার ফাঁদে ফেলা এক গণহত্যার নাম

Golahat Final.jpg
কয়েকটি সামাজিক সংস্থা ও সৈয়দপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কয়েক বছর আগে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৩ জুন। 

মধ্যরাতে সৈয়দপুর রেলস্টেশনের অস্পষ্ট আলোয় তারা নিঃশব্দে ট্রেনে উঠতে থাকেন। যাদের অধিকাংশই ছিলেন মাড়োয়ারি ও বাঙালি হিন্দু। তারা ছিলেন উদ্বিগ্ন, প্রাণভয়ে আতঙ্কিত। একে অপরের পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছিলেন না।

ট্রেনটি সৈয়দপুর রেলস্টেশন থেকে চিলাহাটি সীমান্ত হয়ে ভারতের জলপাইগুড়ি যাবে। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় সময় যেন কাটছে না। একটি ক্ষণ যেন একটি যুগের সমান।

মাড়োয়ারি, বাঙালি হিন্দুসহ বহুসংখ্যক মানুষ ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই সৈয়দপুরে আটকা পড়েন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় উর্দুভাষী বিহারী, যারা ১৯৪৭ সালের পর সেখানে পাড়ি জমান, তারা ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সকাল থেকেই সৈয়দপুরে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন।

সৈয়দপুর থেকে অনেক মাড়োয়ারি ও হিন্দু যুবককে (প্রায় ১৮৫ থেকে ৩০০ জন) সৈয়দপুরে নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে কাজ করানোর জন্য জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়।

জুনের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কয়েকজন ও স্থানীয় রাজাকাররা মাড়োয়ারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সখ্যতা গড়ে তোলেন। তারপর উপকারের মানসিকতা পোষণ করেন। তারা বোঝান, পাকিস্তান সরকার মাড়োয়ারিদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দিতে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে।

সৈয়দপুরে মাইকিং করেও বিশেষ ট্রেনের কথা ঘোষণা দেওয়া হয়। হিন্দু ‘মাড়োয়ারি’দের ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। যুদ্ধের মধ্যে এই ঘোষণা  মাড়োয়ারিদের মনে স্বস্তি নিয়ে আসে। কিন্তু এটা যে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের যৌথ প্রতারণামূলক টোপ ছিল, তা জানার সুযোগ হয়নি এই হতভাগ্যদের। তারা বিশ্বাস করেছিলেন পাকিস্তানি সেনা, বিহারি ও রাজাকারদের।

সংখ্যায় তারা ৪৫০ জনেরও বেশি। ট্রেনে উঠে বসলেন, ভারতে যাবেন। সীমান্ত পার হলেই জীবন তাদের নিরাপদ। এই সীমান্ত যে তাদের পক্ষে কোনোদিনই পার হওয়া হবে না, তারা তা জানতেন না। রেলস্টেশন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে গোলাহাটে যাওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার সামরিক বাহিনী ও রাজাকার ট্রেনে আক্রমণ করে। নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় প্রায় সবাইকে।

বিহারী কাইয়ুম খান, ইজাহার আহমেদ ও তাদের সহযোগীদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র রাজাকারদের একটি দল গোলাহাটের কাছে অপেক্ষা করছিল। নির্মম মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন ১০-১২ জন যুবক পালিয়ে আসতে পারেন।

২০১৪ সালে প্রকাশিত বই ‘গোলাহাট গণহত্যা’য় লেখক আহম্মেদ শরীফ ইতিহাসের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড তুলে ধরেছেন।

আহম্মেদ শরীফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গোলাহাট গণহত্যায় যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাদের ভারতে পাঠানোর টোপ দিয়ে ট্রেনে জড়ো করে হত্যা করা হয়।’

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জাহাঙ্গীর আলম সরকারের লেখা ‘নীলফামারীর ইতিহাস’ বইয়ে ঘটনাটিকে ‘সৈয়দপুরে ট্রেন গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া, শর্মিলা বোসের ‘ডেড রিকনিং: মেমোরিস অব নাইন্টিন সেভেনটি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার’ বইতেও উল্লেখ করা হয়েছে এ গণহত্যার কথা।

১৯৭১ সালের অশান্ত দিনগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী সৈয়দপুরের বাঙালিরা জানান, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরে এটি স্পষ্ট ছিল যে, বাঙালিরা স্বাধীনতার দিকে যাচ্ছে। তখন ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর বাঙালিরা যাদের আশ্রয় দিয়েছিল, সেই বিহারীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশে প্রতিটি মহল্লায় ‘পাকিস্তান বাঁচাও’ কমিটি গঠন করে।

ব্রিটিশ আমল থেকেই অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক ‘মাড়োয়ারি’ সৈয়দপুরে ‘মাড়োয়ারি পট্টি’ নামে একটি অঞ্চলে বাস করতেন।

ইংরেজ সরকার সৈয়দপুরে একটি রেল কারখানা স্থাপন করলে ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য এ শহরটি সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। মাড়োয়ারিরা পাট এবং অন্যান্য ব্যবসার জন্য সেখানকার বাসিন্দা হয়ে ওঠেন।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা’ উড়ানোর দিনটি সারাদেশে পালিত হলেও সৈয়দপুরের চিত্র ছিল ভিন্ন। বিহারিরা বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়ায়।

২৫ মার্চের পর সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারীরা বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করে। হামলা হয় মাড়োয়ারিদের ওপরও।

দ্য ডেইলি স্টার সেই গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া তিন জনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে। যারা সেই কালরাতের সাক্ষী। নিজের চোখের সামনে দেখেছেন স্বজন হারাতে।

সেদিন পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে একজন নিঝু কুমার আগরওয়াল। ৬৫ বছর বয়সী নিঝু অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও বাবা ও বড় ভাইসহ পরিবারের নয় জনকে পাকিস্তানি ও রাজাকাররা হত্যা করেছিল।

তিনি বলেন, ‘১২ জুন বিকেলে সৈয়দপুর সেনানিবাসের দুজন আমাদের রেলস্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। তারা বলেছিলেন, দ্রুত যেতে হবে। কারণ দেরি করলে ট্রেনের বগিতে জায়গা পাওয়া যাবে না।’

স্টেশনে পৌঁছানোর পরপরই সাদা পোশাকে সেনাবাহিনীর সদস্য ও বিহারিরা ট্রেনের বগিগুলোতে সবাইকে উঠিয়ে দেয়।

নিঝু আরও বলেন, ‘সেদিন ট্রেন ছাড়ার আগেই প্রায় ২০ জন মাড়োয়ারি তরুণীকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাদের সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের অভিভাবকদের তখন কিছুই করার ছিল না, নিজের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা ছাড়া।’

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৩ জুন ভোর হওয়ার ঠিক আগে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে।

সেদিনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া তপন কুমার দাস (৭০) জানান, ‘ট্রেনটি খুব ধীরে ধীরে চলছিল। ট্রেনের চাকা রেললাইনে বজ্রপাতের মতো গর্জন করতে করতে প্রায় দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর গোলাহাট এলাকায় রেল কালভার্ট নম্বর-৩৩৮ এর কাছে থেমে যায়। খেয়াল করলাম ট্রেনের দরজা- জানালা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রেনের ভেতর থেকে দেখছিলাম, বিহারীদের হাতে বড় বড় চাকু, ধারালো রামদা। সিভিল পোশাকে সেনা সদস্যরা দূর থেকে দেখছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘বিহারিরা ট্রেনের বগির দরজা খুলে একে একে পুরুষ, নারী এমনকি শিশুদেরও টেনে বাইরে নিয়ে যায়। কুপিয়ে হত্যা করে। জিনিসপত্র লুট করে। মাড়োয়ারিদের আর্ত-চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।’

প্রাণে বেঁচে যাওয়া বিনোদ আগরওয়াল জানান, কুপিয়ে হত্যার এই বীভৎসতা চোখের সামনে দেখে কয়েকজন তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য অনুরোধ করেছিল। বিহারি ও রাজাকাররা উত্তরে বলেছিল, তোদের জন্য পাকিস্তানের দামি গুলি খরচ করা হবে না। তাদেরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।’

বিনোদ বলেন, ‘রেললাইনের দুই পাশে এক বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে হাঁটু সমান গর্তে মরদেহগুলো ফেলে দেওয়া হয়। শিয়াল, কুকুর, শকুনে টেনেহিঁচড়ে তা খায়।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গণহত্যার সময় হত্যাকারীরা ‘খরচাখাতা, খরচাখাতা’ বলে চিৎকার করছিলেন। ‘অপারেশন খরচাখাতা’ ছিল পাকিস্তানি সেনা, বিহারি ও রাজাকারদের পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নাম।

সেদিন গণহত্যার ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া নিঝু কুমার আগরওয়াল সম্প্রতি একটি নির্দিষ্ট জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ঠিক এখানেই আমার বাবা ও ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল’। এ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কয়েকটি সামাজিক সংস্থা ও সৈয়দপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কয়েক বছর আগে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।

সৈয়দপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাসিম আহমেদ জানান, তাদের কাছে গোলাহাট গণহত্যায় ৪৪৮ জন শহীদের একটি তালিকা আছে।

শরীয়তপুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তান সাংবাদিক এম আর আলম ঝান্টু বলেন, ‘সৈয়দপুরে ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় তেমন কিছুই করেনি।’

তিনি জানান, কিছুদিন আগেও তারা জানতেন যে ওইদিনের গণহত্যায় ৪৩৭ জন মারা গেছেন, কিন্তু খোঁজ করতে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে ৪৪৮ জন শহীদের কথা জানা যায়।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

37m ago