যুদ্ধাপরাধের আপিল শুনানি থেমে আছে এক বছর

যুদ্ধাপরাধ বিচারের সর্বশেষ আপিল শুনানি হয় গত বছর ৩ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপিলের শুনানি হয় সেদিন। ট্রাইব্যুনালের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কায়সারের আপিল আবেদনের শুনানি করে আদালত রায় দেওয়ার জন্য এ বছরের ১৪ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন।
supreme-court_0_1.jpg
সুপ্রিম কোর্ট ভবন। স্টার ফাইল ছবি

যুদ্ধাপরাধ বিচারের সর্বশেষ আপিল শুনানি হয় গত বছর ৩ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপিলের শুনানি হয় সেদিন। ট্রাইব্যুনালের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কায়সারের আপিল আবেদনের শুনানি করে আদালত রায় দেওয়ার জন্য এ বছরের ১৪ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন।

পরবর্তীতে গত ১৪ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এরশাদ সরকারের সময়ের প্রতিমন্ত্রী ৭৮ বছর বয়সী কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে কায়সার চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর আপিল বিভাগে একটি রিভিউ আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনের শুনানি এখনো আদালতে মুলতবি আছে।

দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে ২৭টি আপিল আবেদন করা হলেও, ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর থেকে গত এক বছরে আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ বিচারের কোনো আপিলের শুনানি হয়নি।

গত সাত বছরে আপিল বিভাগ সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আবেদনসহ এ পর্যন্ত মাত্র নয়টি আপিল নিষ্পত্তি করেছেন।

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম ও জামায়াতে ইসলামীর আরেক নেতা আবদুস সোবহান মারা যাওয়ায় কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে তাদের করা তিনটি আপিল বাতিল করেন সুপ্রিম কোর্ট।

দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্ট ৪১টি মামলায় রায় দিয়েছেন। আইসিটির দেওয়া ৪১টি রায়ের ৩৯টির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। নয়টি আপিলের নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তিনটি আপিল শীর্ষ আদালত বাতিল করেছেন।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ এর সংশোধনী আসে। সংশোধনীতে ৬০ দিনের মধ্যে সাজার বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির বিধান রাখায় আশা করা হয়েছিল যে, সুপ্রিম কোর্ট মামলাগুলোর রায় দ্রুত দেবেন।

কিন্তু তত্কালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ আইনজীবীরা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করার বিধান কেবল একটি নির্দেশনা ছিল, বাধ্যতামূলক না।

আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আপিল বিভাগে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ মামলা বিচারাধীন থাকায়, যুদ্ধাপরাধ বিচারের আপিলের শুনানি ও নিষ্পত্তি করতে সময় লাগছে।’

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ বিচারের আপিলের শুনানি ও নিষ্পত্তি করতে সুপ্রিম কোর্টের বেশ সময় লাগে। তাই বিচারাধীন মামলার তালিকা বড় হয়।’

এ ছাড়া, চলমান কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আদালতের কার্যক্রম ধীরে চলছে বলেও জানান তিনি।

চলতি বছরের ২০ জুলাই আপিল বিভাগ জানিয়েছিলেন যে, কোভিড-১৯ মহামারির পরে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হলে যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলামের রিভিউ আবেদনের শুনানি হবে। তত্কালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণের আবেদন জানালে, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ কথা জানিয়েছিলেন।

মাহবুবে আলম চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার জন্য জামায়াতে ইসলামী নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখায়, চলতি বছরের ১৯ জুলাই রায়ের পর্যালোচনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে তিনি রিভিউ আবেদন করেন।

যোগাযোগ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গত ১৩ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে আপিল বিভাগ ভার্চুয়াল আদালতে বিচার কাজ পরিচালনা করছে। এ কারণে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরনো মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি হচ্ছে।’

‘আপিল বিভাগে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধের আপিলগুলো সম্পর্কে আমি খোঁজ নেব। যদি আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত থাকে, আগামী জানুয়ারিতে সেগুলোর শুনানির জন্য একটা ব্যবস্থা নেব’, বলেন তিনি।

এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী, এটিএম আজাহারুল ইসলাম এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, এই নয় যুদ্ধাপরাধীর আপিল ইতিমধ্যে শীর্ষ আদালত নিষ্পত্তি করেছেন।

তাদের মধ্যে নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের রায় নিশ্চিত করে শীর্ষ আদালত তাদের রিভিউ আবেদন খারিজ করার পর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

দেলোয়ার হোসেন সাঈদী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখন কারাগারে আছেন।

দোষী সাব্যস্ত যুদ্ধাপরাধী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন, গাইবান্ধার আজিজুর রহমান ও নোয়াখালীর সাইফুদ্দিন আহমেদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে।

২০১৩ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ পাঁচটি বিভিন্ন অভিযোগে গোলাম আজমকে মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন।

২০১৩ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা দেন।

যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী নেতা মাওলানা আবদুস সুবহান চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত করার অপরাধে সুবহানকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেন। পরে সে বছর ১৯ মার্চ সুবহান মৃত্যুদণ্ডের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন।

Comments