তুরস্ক-ইসরায়েল আবার কাছাকাছি আসার নেপথ্যে

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম মুসলিম-প্রধান দেশ তুরস্ক। দেশ দুটির ৬০ বছরের সুসম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয় বছর দশেক আগে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সম্পর্কের তিক্ততা এমন পর্যায়ে আসে যে আড়াই বছরের বেশি হলো তুরস্কের কোনো রাষ্ট্রদূত নেই তেল আবিবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু (বামে) ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম মুসলিম-প্রধান দেশ তুরস্ক। দেশ দুটির ৬০ বছরের সুসম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয় বছর দশেক আগে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সম্পর্কের তিক্ততা এমন পর্যায়ে আসে যে আড়াই বছরের বেশি হলো তুরস্কের কোনো রাষ্ট্রদূত নেই তেল আবিবে।

আঙ্কারা আবার তেল আবিবে রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে কট্টর অবস্থান নেওয়া তুরস্ক কেন আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে?

এখনো পর্যন্ত তুরস্ক সরকার কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও গত সপ্তাহে ‘ঘনিষ্ঠ সূত্রের’ বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-মনিটর জানিয়েছিল, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে গবেষক উফুক উলুতাসকে রাষ্ট্রদূত করে তেল আবিবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুরস্ক।’

সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উলুতাস পেশাদার কূটনীতিক নন। তিনি তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণা বিভাগের প্রধান। এর আগে তিনি সরকারদলীয় ‘থিঙ্ক ট্যাংক’এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

সেই ‘থিঙ্ক ট্যাংক’এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, উলুতাস জেরুসালেম হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে হিব্রু ভাষা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ওপর পড়ালেখা করেছেন।

সূত্র আল-মনিটরকে আরও জানিয়েছে, ‘খুবই মার্জিত’ ও ‘ভীষণ ফিলিস্তিনপন্থি’ উলুতাসকে দুই দেশের মধ্যে চলমান ‘অত্যন্ত খারাপ কূটনৈতিক সম্পর্ককে’ আবার ভালোর দিকে নিয়ে যেতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

সম্পর্ক খারাপ হয় যেভাবে

১৯৪৯ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া তুরস্ক দীর্ঘ ছয় দশক দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে।

২০০২ সালে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে দেশ দুটি বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও পর্যটন খাতে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল।

ক্ষমতায় আসার পর এরদোয়ান ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব অবসানে শান্তির বার্তা নিয়ে ইসরায়েল সফর করেছিলেন। ২০০৮-২০০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে অভিহীত করেছিলেন তিনি।

২০১০ সালে ইসরায়েলের দেওয়া গাজা অবরোধ ভাঙতে খাদ্য-ওষুধ সহায়তা নিয়ে গাজামুখী নৌকা ‘মাভি মারমারা’য় হামলা চালিয়ে ইসরায়েল নয় তুর্কি নাগরিক ও এক আমেরিকান-তুর্কি সহায়তাকর্মীকে হত্যা করায় দুই দেশের দীর্ঘ ৬০ বছরের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে।

এর ছয় বছর পর, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সেই হামলার জন্যে ক্ষমা চাইলে ও ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিলে সম্পর্ক একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

তবে ২০১৮ সালে জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এবং এর প্রতিবাদে আন্দোলনরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল হামলা চালালে প্রতিবাদ হিসেবে ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত সরিয়ে নেয় তুরস্ক।

দেশ দুটিতে একে অপরের দূতাবাস থাকলেও শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তেল আবিব ও আঙ্কারা।

তারপরও দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্য চলেছে পুরোদমে। তুরস্কের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাবে, গত আট বছরে প্রতিবছর বাণিজ্য হয়েছে ছয় বিলিয়ন ডলারের মতো। চলতি বছরের গত ১০ মাসে দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

বিশ্লেষকদের ধারণা, পুরো মাত্রায় কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে তা শুধু দুই দেশের বাণিজ্য বাড়াতেই সাহায্য করবে।

এরদোয়ানের নতুন সিদ্ধান্তের কারণ

ট্রাম্প প্রশাসনের চাপে ও বাণিজ্যিক-ভূরাজনৈতিক সুবিধা পেতে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার চার আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ইসরায়েল। আবার একইভাবে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য চাপের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েলে নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্তের পেছনে হয়তো আন্তর্জাতিক চাপ ও দেশের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি কাজ করতে পারে।

এছাড়াও, হোয়াইট হাউসে জো বাইডেন এলে তুরস্কের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে চাপে পড়তে পারে আঙ্কারা। সিরিয়া, লিবিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্ঠাও বাইডেন প্রশাসন কঠোরভাবে দমন করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

এদিকে, তুরস্কের দীর্ঘ দিনের মিত্র ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র আঙ্কারার ওপর অবরোধ আরোপে একমত হয়েছে। ইউরোপ তুরস্কের ওপর অবরোধ দিতে চায় পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য গ্রিস ও সাইপ্রাসের সঙ্গে আঙ্কারার দ্বন্দ্বের কারণে। আর মার্কিন অবরোধের কারণ তুরস্কে রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন।

সম্প্রতি, জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক লিসেল হিনৎজ সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এরদোয়ান সুন্নি মুসলমানদের নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান। তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে দেশে ও দেশের বাইরে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।’

তার মতে, ‘কিন্তু, এখন দেশের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণে আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে বিষয়টিকে হয়তো এরদোয়ান তুরস্কের বিজয় হিসেবেই তুলে ধরতে চাচ্ছেন।’

তুরস্কের এক সাবেক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে তুরস্ক ইসরায়েলে নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

তবে যে কারণেই তুরস্ক ইসরায়েলে রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্ক ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে।

ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে ইসরায়েল ও মিশর নতুন করে জোট করেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানোর পথে হাঁটছে সৌদি আরব। তাকে সামনে রেখে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলো।

বিশ্লেষকদের মতে, এমন বাস্তবতায় তুরস্ককেও হাঁটতে হচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে।

আরও পড়ুন:

২ বছর পর ইসরায়েলে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ তুরস্কের

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago